তামাকের জন্য বিখ্যাত জেলা রংপুর পূর্বে রঙ্গপুর নামে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় রঙ্গপুর থেকে রংপুর নামে স্থায়িত্ব লাভ করেছে এই জেলা। রংপুর উত্তর বঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য জেলা। রংপুরের সাধারণ মানুষ খুব অতিথি পরায়ণ ও সরল মনের হয়।
রংপুরে বেড়াতে গেলে তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হতে হয়। রংপুরে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলও কারমাইকেল কলেজ, তাজাহাট রাজবাড়ী, ভিন্নজগত পার্ক, রংপুর চিড়িয়াখানা, পায়রাবন্দ, ঘাঘট প্রয়াস পার্ক, চিকলির পার্ক ইত্যাদি। তবে ভিন্নজগত পার্ক অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য একটি বিনোদন কেন্দ্র।
ভিন্নজগত পার্ক

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া গুঞ্জিপুর এলাকায় একশো একর বিস্তৃত জায়গাজুড়ে ভিন্ন জগত পার্ক নামের বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই পার্কটি গড়ে উঠেছে ২০০১ সালে। এটি বেসরকারি মালিকানায় স্থাপন করা হয়েছে। রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে তেমন উল্লেখযোগ্য বিনোদন কেন্দ্র ছিল না। বেসরকারি মালিকানায় নির্মিত ভিন্নজগত পার্ক বিনোদনে নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। রংপুর শহর থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে এই পার্কটি অবস্থিত।

ভিন্নজগত পার্কে রয়েছে সবুজের ছোঁয়া। এখানে বৃক্ষলতা, গাছ গাছালি, লতাগুল্ম ও ঝোপঝাড় রয়েছে। শহরের অদূরে গ্রামীণ পরিবেশে এই পার্কটি স্থাপন করা হয়েছে। অনেক গাছগাছালি ও বৃক্ষলতা থাকায় দর্শনার্থীরা পাখির কলতান ও কিচির মিচিরে মত্ত থাকে সারাক্ষণ।
শুধু দেশী গাছ নয়, এখানে শোভা পেয়েছে অসংখ্য নাম না জানা বিদেশী গাছও। দর্শনার্থীরা সারাটা দিন গাছের ছায়ায় প্রশান্তির সাথে কাটিয়ে দিতে পারে। বুক ভরে সবুজের ঘ্রাণ নিতে পারে।
ভিন্নজগতে রয়েছে চমৎকার লেক। পার্কের প্রধান ফটক পার হলেই তিন দিকের বিশাল লেক চোখে পড়ে। আরেকটু সামনে গেলে চোখে পড়ে লোহার ব্রীজ। সবুজে ঘেরা চমৎকার লেক দেখে নয়ন জুড়াবে যেকোনো পর্যটকের। নাগরিক জীবনের রোগ, শোক, জরা, ক্লান্তি মুছে দিতে সবুজের বিকল্প নেই। লেকের পানির পরিষ্কার রাখার যথার্থ চেষ্টা করা হয়। লেকের পাড়ে রয়েছে গাছ গাছালি ও ছোট বড় ফুলের গাছ। মনে হয় লেকের পাড়ে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষগুলো।
লেকের পানিতে নৌকা ভ্রমণে যেতে পারবেন। এখানে নৌকা ভ্রমণ করার জন্য সুব্যবস্থা আছে। বিকেলের আলতো রোদে নৌকা নিয়ে একটু ঘুরলে মন্দ হবে না। লেকের পানিতে প্রায়ই শাপলা ফুটে থাকে। যদিও সবসময় তা থাকে না। চাইলে এখানে মাছ ধরতে পারে পর্যটকরা। শহুরে নাগরিক যারা কখনো মাছ ধরার আনন্দ পায়নি কিংবা শৈশবের দিনগুলো ফিরে পেতে চায় তাদের জন্য ভিন্ন জগত এক অনন্য স্থান। কারণ এখানে রয়েছে মাছ ধরার সুন্দর ব্যবস্থা।

ভিন্নজগত পার্কে রয়েছে প্লানেটোরিয়াম বা নক্ষত্র নিয়ে শো দেখানোর ব্যবস্থা, যা আধুনিক বিশ্বের এক বিস্ময়! এটিই দেশের প্রথম প্লানেটোরিয়াম। এছাড়াও এখানে রয়েছে জল তরঙ্গ, স্পেস জার্নি, রোবট স্ক্রিল জোন, শাপলা চত্বর, আজব গুহা, সি প্যারাডাইস, নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা, ওয়াক ওয়ে, থ্রিডি মুভি দেখার ব্যবস্থা, মেরি গো রাউন্ড, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, ভাষা সৈনিকদের ভাস্কর্য, ফ্লাই হেলিকেপ্টার, লেক ড্রাইভ, সুইমিং পুল, মাছ ধরার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

শুধু বড়দের জন্য নয় শিশুদের জন্যও ভিন্ন জগতে রয়েছে মজাদার কিছু জিনিস। শিশুদের বিনোদনের জন্য এখানে ক্যাঙ্গারু, ঘোড়া, হাতি ও অন্যান্য প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। শিশুরা এদের দেখে খুব আনন্দ পায় এবং উপভোগ করে। শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
ভিন্নজগত পার্কে রয়েছে পিকনিক স্পট। পিকনিক স্পটে একসাথে পাঁচটি দল পিকনিক করতে পারবে। বিশাল জায়গাজুড়ে এর অবস্থান হওয়ায় অনেক লোকের সমাগমেও ঝামেলা ও বিশৃঙ্খলা হয় না। এখানে রয়েছে ৭টি কটেজ। প্রতিটি কটেজে রয়েছে শৈল্পিকতার ছোঁয়া। পার্কের ভেতরে গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। আটশো থেকে নয়শো গাড়ি পার্কিং করা যায় পার্কের অভ্যন্তরে।
এছাড়া এখানে রয়েছে থ্রি স্টার মডেলের ড্রিম প্যালেস যা দেখতে অনেক সুন্দর। সুইমিং পুলে ছোট-বড় সবাই নামতে পারে। রংপুর শহর থেকে দূরে অবস্থিত হলেও হাজারো পর্যটক ভিন্ন জগতে বেড়াতে আসে এবং সকল মাধুর্য ও বিনোদন উপভোগ করে। সুইমিং পুল গ্রামের পরিবেশে বেড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের কাছে অন্যরকম ভালো লাগার পরিচয় বহন করে। এখানে শিশু, কিশোর ও বড়রা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে পারে।

ভিন্নজগত পার্কে গড়ে তোলা হয়েছে পিরামিড, তাজমহল, আইফেল টাওয়ার, ঘণ্টা ইত্যাদি। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে থিম পার্ক, শিশুপার্ক, রাইড ও চিড়িয়াখানা। ভিন্নজগত পার্কে মসজিদের ব্যবস্থাও রয়েছে।

এখানে দর্শনার্থীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা ও রাইডে চড়ার পাশাপাশি মসজিদে নামাজও পড়তে পারে। পশ্চিমদিকে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে হয় সূর্যটা তাজমহলে গিয়ে ডোবে। সূর্য ডোবার সময়টা সত্যিই দারুণ।
প্রবেশমূল্য
ভিন্নজগত পার্কে প্রবেশমূল্য কম। মাত্র ৩০ টাকা। রংপুরের পরিবেশে এরকম সুন্দর বিনোদন কেন্দ্র অন্য একটিও নেই। ভেতরে বিভিন্ন রাইডে চড়ার জন্য আলাদা প্যাকেজ রয়েছে। জনপ্রিয় ২০টি রাইডের টিকেট কিনতে হয় ৩৮০ টাকা দিয়ে। রাইড ভেদে দামের ভিন্নতা রয়েছে।
যাওয়ার উপায়
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী, কল্যাণপুর থেকে এসি ও নন এসি বাস সরাসরি ঢাকা থেকে রংপুর যায়। গ্রীণলাইন পরিবহন, আলহামরা ট্রাভেলস, মীম পরিবহন, এস আর ট্রাভেলস, কুড়িগ্রাম ট্রাভেলসে করে মানভেদে ভাড়া দিয়ে রংপুরে যাওয়া যায়। এস আর ট্রাভেলসে গাবতলী, মহাখালি, উত্তরা ও কল্যাণপুর থেকে ওঠা যায়।
ঢাকা থেকে রংপুর যেতে ভাড়া লাগবে ৫০০-১,০০০ টাকা এবং সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। রংপুরে নেমে ভিন্ন জগতে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ব্যাটারিচালিত ইজি বাইকে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ভিন্ন জগত পার্কে যাওয়া যায়।
থাকার ব্যবস্থা
পার্কে থাকার জন্য কটেজ রয়েছে। এছাড়া থ্রি স্টার মানের ড্রিম প্যালেসে থাকতে পারেন। একদিনের জন্য খরচ হবে ,১০০০ থেকে ৩,৫০০ টাকা। অথবা রংপুরের অন্যান্য আবাসিক হোটেলেও থাকতে পারেন।
ফিচার ইমেজ- vromon guide