প্রথমে যে কারোরই ভ্রম ঘটতে পারে এটা কি সত্যি সত্যি কুল বাগান না খাটো জাতের আপেল বা আম বাগান? সবুজ আম বা আপেল আকৃতির বাউকুলে ভরা প্রতিটি গাছ দেখে মনে হবে এ যেন বিদেশী কোনো ফ্রুটজোন। প্রতিটি গাছ পাকা আর আধা পাকা কুলে মাটির দিকে ঝুলে পড়েছে। আর একটু অনুধাবন করলে মনে হবে ঝাকে ঝাকে যেন পাখিদের খাবারের মেলা বসেছে। পুরো বাগান জুড়েই এ অবস্থা বিরাজ করছে।

দুই বিদেশ ফেরত বন্ধু নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আলম ভিন্ন কিছু করার চিন্তা থেকে নিতান্ত শখের বসে ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঈদগড় ইউনিয়নের বউঘাটা এলাকায় ৫ একর জমি ইজারা নিয়ে শুরু করেছিলেন “মেম্বার বহুমুখী এগ্রো ফার্ম” নামে এই বাউকুলের বাগান।

যেকারোরই হুট করে শখ জাগতে পারে বাগানে কুল আহরনে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে কাজে লেগে যাওয়ার। আর বাগান মালিক নাজিম উদ্দিনও খুশি মনে পর্যটকদের কুল আপ্যায়ন করার পাশাপাশি দিয়ে থাকেন কুল আহরণ করার সুযোগ। এ বাগানে এসে কুল খাওয়ার চেয়ে আহরণ ও ঘুরে বেড়ানোই সবচেয়ে আনন্দময়। আর এ বাগানে মূলত যারা বেড়াতে আসে তারা ডিসেম্বর-মার্চ কুল পাকার সময়ে আসে।

স্বাদ এবং আকারে ভিন্নতা থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে ভোক্তার নজরে চলে আসে এই বাগানের কুল। চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে দিন দিন। লোকমুখে এখন এই বাগানের কুল “ঈদগড়ের বরই” নামে পরিচিত। ঈদগাঁও, কক্সবাজার সদর, চকোরিয়া, উখিয়া এবং মহেশখালীতে সরবরাহ করা হয় এ বাগানের কুল। অল্প কিছু সংখ্যক যায় চট্টগ্রামে। মাঝেমধ্যে হিমশিম খেতে হয় সকল ক্রেতার চাহিদা মেটাতে গিয়ে।

কক্সবাজার জেলার প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিকট থেকে অর্ডার নেওয়ার আবদার আসে। কিন্তু প্রায় সময় তা রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে যারা সরাসরি বাগানে চলে আসে কুল সংগ্রহের জন্য তাদের আবদারকে আর না করা যায় না।
কুল বাগান বলে যে শুধু কুলই থাকবে এমন কোনো কথা নেই। আপনি যখন পুরো বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবেন তখনই আবিষ্কার করতে পারবেন আরও হরেক রকমের শাক-সবজি, যা আপনাকে বিমোহিত করবে। বাগানের একেবারে পূর্ব পাশে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলে দেখতে পাবেন সারি সারি সীমানার সাথে লেবু গাছ। আর লেবুগুলো অপেক্ষা করছে আপনি ছিড়ে নেওয়ার জন্য। কারণ বাগানের কর্মরত শ্রমিকদের যে এসব ছেড়ার সময় নেই।

আরেকটু ভেতরে আসলে দেখতে পাবেন টমেটো, মুলো, মরিচ আর ধনেপাতার ক্ষেত। এসবও কারও সময় হলে তুলে আনে আর না হয় ওখানেই পঁচে যায়। আবার যে জায়গাটুকুকে কুল চাষের জন্য অনুপযোগী বলে মনে করে কুলের চারা রোপন করা হয়নি সেখানে করা হয়েছে ঢেড়সের চাষ।
পুরো বাগান তো হেঁটে দেখে ফেললেন, এবার নিশ্চয় আপনার একই সাথে বাগানের পুরোটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আবার বাগানের বিশালতাও তেমন বুঝতে পারছেন না। হ্যাঁ, তাই আপনার জন্য করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ারের ব্যবস্থা। যেখান থেকে এক নিমেষে দেখে ফেলতে পারবেন পুরো বাগান, আবার তুলতে পারবেন ইচ্ছেমতো ছবি।

সাধারণত মার্চে প্রতিটি গাছের মূল রেখে সকল ডাল-পালা কেটে ফেলা হয়। আর এই মূলের গোড়াতে সারা বছর সার, কীটনাশক দিয়ে পরিচর্যা করা হয়। মূল থেকে আগের চেয়ে বিস্তৃত আকারে ডাল-পালা বের হয়। মুকুল আসলে শুরু হয় আরেক ধাপের পরিচর্যা, যা চলে কুল পাকা পর্যন্ত। কুল পাকতে শুরু করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে।
পাঁচশ গাছের পরিচর্যা করার জন্য ৬ জন স্থায়ী ও পনের জন অস্থায়ী কর্মী রয়েছে। দশ লক্ষ টাকা মুলধনে গত বছর মোট কুল উৎপাদন হয়েছে উনচল্লিশ টন। আর লাভ হয়েছে ৯ লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার টাকা।

নিয়মিত ভোক্তা জাফর আলম বলেন, বাজারে এই বাগানের কুল আসার জন্য অপেক্ষায় থাকি। অন্য কোনো কুল এখন আর স্বাদ লাগে না। গুণগত মানের ভরসাও পাই না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উসৈশিং এই কুল খেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বাগান পরিদর্শনে এসেছিলেন চ্যানেল আই’র পরিচালক ও কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান “হৃদয়ে মাটি ও মানুষ” এর উপস্থাপক শাইখ সিরাজ।

পাইকারি আড়তদার সাঈদী বলেন, স্বাদে এবং আকারে বড় হওয়ায় অন্যান্য কুলের চেয়ে কেজি প্রতি দশ টাকা বেশি বিক্রি করতে পারি এ বাগানের কুল। খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তারাও কিনছে খুশি মনে।
এ বছর এ পর্যন্ত ৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কুল আহরণ হয়েছে সাত টন। আর আয় হয়েছে চার লক্ষ টাকা। প্রতিদিন সাতশ কেজি কুল বাজারে সরবরাহ করা হয়। এখনো কুল পাকার মৌসুম শুরু হয়েছে। যা চলবে মার্চ নাগাদ। তাই মালিকেরা এ বছর তাদের লক্ষমাত্রা ছেচল্লিশ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন।

বাগান মালিক নুরুল আলম বলেন, আমাদের থেকে উৎসাহ পেয়ে এখন অনেকে কুল চাষের দিকে ঝুকছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যৎ এ আমাদের আরও বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে।
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ.ক.ম. শাহরিয়ার বলেন, আমরা খুবই সন্তুষ্ট এই বাগান নিয়ে। আর তাদের মধ্যে যে আন্তরিকতা রয়েছে তা উৎসাহ দিচ্ছে নতুনদের। আশা করছি ২/১ বছরের মধ্যে তারা অনেক বড় সফলতা পাবে। আর তাদের কোনো ধরনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতার দরকার হলে আমরা দিতে প্রস্তুত।

রামু উপজেলার এই ঈদগড় ইউনিয়নে বেশ কয়েক বছর ধরে কুল বাগান করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে রয়েছে ১৭টি কুল বাগান। যারা পর্যটক হয়ে আসে তারা বাগান দেখার পাশাপাশি বাগান মালিকদের থেকে জানতে পারছে কুল বাগান করার নানা দিক নিয়ে। মালিকরাও কথা বলছেন খুশি মনে। আশা করা যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এই এলাকার কুল আশেপাশে সকলের চাহিদা মিটিয়ে দিতে পারবে।
ফিচার ইমেজ : মোনেন উদ্দিন চৌধুরী