রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চলের কোটবাড়ি নামক স্থানে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বিএআরডি) অবস্থিত। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বার্ডের অবস্থান। এই একাডেমিতে রয়েছে পাঁচটি হোস্টেল, চারটি কনফারেন্স কক্ষ, একটি মসজিদ, একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, হেলথ ক্লিনিক, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, দু’টি ক্যাফেটেরিয়া ও একটি প্রাইমারী স্কুল। স্বায়ত্ত্বশাসিত এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিবর্গের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা ও গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে।
গত বছর ঈদের তৃতীয় দিন রিকশায় করে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কুমিল্লায় যাওয়ার বাস দেখে, হুট করে নীলান্তির মনে হলো, “কুমিল্লা গেলে কেমন হয়?” আমি তো ঘুরতে পছন্দ করি। কুমিল্লায় কদিন আগেই একবার ঘুরে এলেও, “হ্যাঁ” বলতে দুইবার ভাবলাম না। কিন্তু পিনি বললো, ওর ফুপির বাসায় দাওয়াত আছে। কী আর করা, ফ্যামিলি প্রোগ্রাম, না গেলে তো চলবে না। তারপর, আদিকে জিজ্ঞেস করলাম, তাকেও নাকি বাসা থেকে দেবে না। পুষ্পকে ফোনে পেলাম না। মাহিদ, মারজানকে বললাম, একটার বিয়ের দাওয়াত আছে, অন্যটা তো পালটা ঝাড়ি দেওয়া শুরু করলো। এখন কুমিল্লা যেতে নাকি খুব জ্যাম পড়বে, কুমিল্লায় দেখার কী আছে, ইত্যাদি হ্যান ত্যান, ভাতের ফ্যান।
তাসনুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে আসতে পারবি?” আমি কুমিল্লা যাচ্ছি শুনে বেচারি দুঃখে মরে যায়, এমন একটা দিন, সে আছে নানুবাড়ি, সেখান থেকে বেরুতে পারবে না। তার উপর হলো শুক্রবার, কোনো অজুহাতই খাটবে না। শুক্রবার শুনে ভাবলাম, নিলয় হয়তো পারবে, সে বললো, সকালে ডেকে দিস; উঠতে পারলে যাবো। শেষ পর্যন্ত সে উঠতে পারলো না।
অবশেষে আমি আর নীলান্তি বুঝতে পারলাম, আমি আর সে ছাড়া যাওয়ার মতো কেউই নেই। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বেশ তো! দুজনেই যাবো। ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল।
শেষ যেবার গিয়েছিলাম, বার্ডে ঢুকতে পারিনি। এবারেও শুরুতেই বারণ করে দিলো। বহু অনুনয় করেও তাকে রাজি করাতে পারলাম না। দুজনে মন খারাপ করে পিছন ফিরতেই গার্ড ডাকলো। গার্ডরুমে ডেকে ফিসফিসিয়ে যা বললো, তার সারমর্ম হলো, কিছু টাকা হলেই ঢুকতে পারবো। একশো টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের মন খারাপ হতে দেখেই হোক কিংবা একশো টাকার জন্যই হোক, গার্ড আমাদের ঢুকতে দিলো।
ঢুকতেই দুটো আলাদা রাস্তা দু’দিকে চলে গেছে। ডান দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। সুন্দর জায়গা, কিন্তু কোনো বৈচিত্র্য নেই। পিচঢালা রাস্তা, আর দুই ধারে সারি সারি গাছ। ওদিকে বৃষ্টির পর পরই রোদ উঠায় ভ্যাপসা গরম লাগছে। কী করি? অনন্ত কাল ধরে হাঁটতেই থাকবো নাকি?
খানিক বাদেই চমৎকার একটা অপশন পেলাম। রিকশায় লোকজন আসছে যাচ্ছে। খালি একটা রিকশা পেতেই একশো টাকা ভাড়া ঠিক করে উঠে পড়লাম। শেষ কবে এত স্মুথ রিকশা রাইড করেছি মনে পড়ে না। আর ঝিরঝিরে বাতাসটা ভ্যাপসা গরমে শান্তির পরশ জোগাচ্ছিল।
বার্ডের কর্মচারী কর্মকর্তাদের গাছঘেরা ছোট ছোট কোয়ার্টারগুলো খুব ভালো লাগলো। মনে হলো, আহা! আমিও যদি এই ধরনের কোনো চাকরি করতে পারতাম! যতটুকুতে রিকশা যাওয়ার অনুমতি আছে, ততটুকু ঘুরলাম। রিকশা ভ্রমণটা খুব ভালো ছিল। ঘুরেফিরে ক্যাফেটেরিয়ায় এলাম। বার্ডের খাবার নাকি বেশ ভালো। এসে দেখি তখনো খোলেনি ক্যাফেটেরিয়া। পাশেই বার্ডের পাঠাগার। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, চমৎকার দেয়ালিকা জুড়ে দিয়েছে পাঠাগারের দেয়ালে। একটা দেয়ালিকা দেখে মনে হচ্ছিল, বার্ড বুঝি এককালে এমনই ছিল! অন্যটায় আদর্শ নগরী আর দূষিত নগরীর মডেল। এছাড়া বার্ডের লেখিয়েদের গদ্য পদ্য তো ছিলই।
ঘুরে এসে ক্যাফেটেরিয়ায় বসতেই খাবার রেডি হয়ে গেল। এখানে আবার সেলফ সার্ভিস। থালায়, বাটিতে করে ভাত-তরকারী সাজানো আছে আলাদা আলাদা করে, যার যেটা লাগবে, নিয়ে নেবে। আমরা একটা ভাত (দুইজনের জন্য যথেষ্ট ছিল), একটা কই মাছ, একটা রুই মাছ, একটা সবজি নিলাম। ভর্তা পাইনি বলে আফসোস হলো। সব মিলিয়ে বিল এলো মাত্র ১৮৫ টাকা।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন স্বায়ত্ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান। বার্ড VAID (Village Agricultural & Industrial Development) প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের গ্রামে অবহেলিত মানুষের সমস্যা সহ গ্রামের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ১৯৫৯ সালের ২৭ মে পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমী নামে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা উত্তর এর নামকরণ হয় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বার্ড। সাবেক আই সি এস অফিসার, প্রখ্যাত দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. আখতার হামিদ খাঁন এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বার্ড কর্তৃক উদ্ভাবিত পল্লী উন্নয়নের “কুমিল্লা মডেল” এর অন্তর্গত দ্বিস্তর সমবায়, থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র, পল্লী-পূর্ত কর্মসূচি ও থানা সেচ কর্মসূচি এ চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়া সহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা চলছে।
পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন তথা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করা এর প্রধান কাজ। পল্লী অঞ্চলের আর্থ সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করণ, নীতি নির্ধারণে পরামর্শ প্রদান ও মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নই বার্ডের প্রধান লক্ষ্য। সার্বিক পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে বার্ডের পাঁচটি একাডেমিক বিভাগ (পল্লী প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার, পল্লী অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা, পল্লীশিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন, পল্লী সমাজতন্ত্র ও জনমিতি, কৃষি ও পরিবেশ) এবং চারটি সার্ভিস বিভাগ (প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকল্প ও প্রশাসন) রয়েছে। একাডেমীর কার্যক্রম ২১ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১৫৬ একর জমির উপর বিএআরডি ক্যাম্পাসটি অবস্থিত। ক্যাম্পাসের বেশীরভাগ অংশেই রয়েছে অর্কিড গাছ, সবজি বাগান, নার্সারি, পার্ক। এখানকার রাস্তাগুলোর পাশে রয়েছে ছায়াবৃক্ষ। এলাকার ভৌগলিক চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এখানকার অফিস, বাংলো, ডরমিটরি ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাসভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণের ফলে সবুজে ঘেরা বিএআরডি ক্যাম্পাসটিতে সবসময়ই এক ধরনের প্রশান্তি বিরাজ করে।
বিএআরডির অভ্যন্তরে সময় কাটানোর জন্য বেশ কিছু স্থান রয়েছে যেমন: ক্যাফেটারিয়া, টেনিস কোর্ট এবং অন্যান্য খেলার মাঠ। এছাড়া ‘নীলাচল’ এবং ‘বনশ্রী’ নামে বিএআরডির অভ্যন্তরে দুটি স্থান রয়েছে যেখানে আপনি সারাদিন প্রকৃতির কাছাকাছি কাটাতে পারেন। সেখানে বিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা।
খাবার সুবিধা:
বিএআরডির ক্যাফেটারিয়াতে খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। এখানে বেড়াতে এলে এই ক্যাফেটেরিয়ার খাবারই খাওয়া উচিৎ। এছাড়া কুমিল্লা শহরেও খাওয়ার জন্য বেশ কিছু হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে।
সতর্কতা:
পূর্বে বিএআরডিতে প্রবেশের জন্য অনুমতির প্রয়োজন না হলেও বর্তমানে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। বিএআরডিতে থাকার ব্যবস্থা আছে তবে এখানে থাকতে হলে আপনাকে নিয়ে নিতে হবে আগাম অনুমতি।
কীভাবে যাবেন:
বিএআরডিতে যেতে হলে কুমিল্লা সেনানিবাসে নেমে যাওয়াই ভালো কারণ সড়কপথে বাসগুলোর গন্তব্য হলো কুমিল্লা শহর আর বিএআরডি সেনানিবাসের কাছেই অবস্থিত। সেনানিবাস থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে ৬০/- টাকা থেকে ৮০/- টাকা ভাড়ায় বিএআরডিতে যেতে পারবেন যদিও অটোরিকশা চালক আপনার কাছে এর চেয়ে বেশি ভাড়া চাইতে পারে। এছাড়া সেনানিবাস থেকে বিএআরডিতে হিউম্যান হলার অথবা মিনিবাসে করে ১০/- টাকা থেকে ১৫/- টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন। সেনানিবাস থেকে বিএআরডিতে পৌঁছাতে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় লাগবে।
কুমিল্লার সাথে সারাদেশের রয়েছে চমৎকার পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে কুমিল্লায় যাওয়া যায়। কুমিল্লায় একটি বিমানবন্দর থাকলেও বর্তমানে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ৯৭ কিলোমিটার। আপনি বাসে করে সড়কপথে কুমিল্লায় পৌঁছাতে পারবেন। আপনার সুবিধার্থে কুমিল্লায় চলাচলকারী বাসগুলো সম্পর্কে নিম্নে তথ্য প্রদান করা হলো:
১। উপকুল রয়্যাল
কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড
যোগাযোগঃ ০১৯৮১-০০২৯৩২, ০১৯৮১-০০২৯৪২
২। তিশা
সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড
যোগাযোগঃ ০১৭৩১-২১৭৩২২
৩। বিআরটিসি
কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড
যোগাযোগঃ ০১৭৭০-৪৯৩৭৭৫
৪। প্রাইম সার্ভিস
হ্যাচেল রোড
যোগাযোগঃ ০২-৯৫৫৪৪৯৬
সকাল ৬:১৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতি ১৫ মিনিটে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়।
বাস ভাড়া: প্রায় ২২০/-টাকা
কোথায় থাকবেন:
কুমিল্লায় থাকার জন্য কিছু হোটেল ও গেস্টহাউজ সম্পর্কে নিম্নে তথ্য প্রদান করা হলো-
১। আশিক রেসিডেনসিয়াল রেস্ট হাউজ
ঠিকানা: ১৮৬, নজরুল এভিনিউ কুমিল্লা
যোগাযোগ: ৬৮৭৮১
২। হোটেল আবেদিন
ঠিকানা: স্টেশন রোড কুমিল্লা
যোগাযোগ: ৭৬০১৪
৩।হোটেল নুরজাহান
ঠিকানা: ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা
যোগাযোগ: ৬৮৭৩৭
৪। হোটেল সোনালি
ঠিকানা: কান্দিরপাড় চত্বর, কুমিল্লা
যোগাযোগ: ৬৩১৮৮
ফিচার ইমেজ- অফরোড বাংলাদেশ