গত পাঁচ-ছয় বছরে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে এক অসাধারণ পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এক ঝাঁক উদ্যমী পর্যটকের, যাদের সংখ্যা দিন দিন খুব ভালোভাবে বাড়ছে। এদের মধ্যে একদল ট্রাভেলার আছেন যারা খুব বিলাসবহুল ভ্রমণের চেয়ে সৌন্দর্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তারাই হলেন আমাদের বাজেট ট্রাভেলার। খুব কম খরচে কীভাবে বেশি জায়গা ঘুরে আসা যায় সেটাই হচ্ছে বাজেট ট্রাভেলারদের মূল উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ ঘুরতে খুব বেশি যে টাকার প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। চাইলে খুব কম খরচে বেশ ভালো ভালো জায়গা থেকে ঘুরে আসা সম্ভব। কম খরচে ঘুরে আসতে প্রয়োজন একটি ভালো ট্যুর পরিকল্পনা আর একটা ৪-৫ জনের গ্রুপ। সম্পূর্ণ ট্যুর পরিকল্পনা দেয়ার পাশাপাশি এই সিরিজের লেখাগুলোয় থাকবে কোথায় ঘুরতে ঠিক কত খরচ হতে পারে সে বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য।
এই সিরিজের আজকের লেখা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা নিয়ে। বরিশাল শহর থেকে ১১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। চলুন তাহলে শুরু করা যাক কুয়াকাটায় বাজেট ট্রিপের ইতিবৃত্তান্ত।

যারা খুলনা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জের দিকটায় থাকেন তাদের জন্য সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের কক্সবাজার, পতেঙ্গা অথবা সেইন্ট মার্টিনে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য। তবে প্রকৃতি সব কিছুরই একটা বিকল্প ঠিক করে রেখেছে। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ইচ্ছে করলেই সমুদ্র দেখতে পারে কুয়াকাটায় এসে। কুয়াকাটায় সাগর ছাড়াও দেখার মতো বেশ কয়েকটা জায়গা রয়েছে। অত্যন্ত সহজ ট্যুর পরিকল্পনায় ঘুরে আসা যায় কুয়াকাটা থেকে।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটার সরাসরি বাস আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে কুয়াকাটায় সৌদিয়া আর সাকুরার বাস দেখেছি আমি। সরাসরি ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভাড়া সম্ভবত ৯০০ টাকা। আর সরাসরি কুয়াকাটার বাস না পেলেও বরিশালের প্রচুর বাস পেয়ে যাবেন সায়েদাবাদ থেকে। ঢাকা থেকে বরিশালের বাস ভাড়া ৫০০-৭০০ টাকা। যারা খরচ আরো কমাতে চান তারা প্রথমে সায়েদাবাদ এসে মাওয়া ঘাটের বাসের টিকেট কাটুন ৭০ টাকা দিয়ে।
মাওয়া ঘাট নেমে যাত্রী লঞ্চে করে পার হোন পদ্মা নদী, ভাড়া নেবে ২০-৪০ টাকা। লঞ্চেই দুপুরের খাবার খেতে পারেন পদ্মার ইলিশ আর সাদা ভাত দিয়ে, দাম ১০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। পদ্মা নদী পার হয়ে এদিকটার ঘাটের নাম হলো কাঠালবাড়ি। কাঠালবাড়ি থেকে বরিশালের প্রচুর বাস পাবেন, ভাড়া ৩০০-৩২০ টাকা। ব্যস, ৪০০ টাকার মধ্যে ঢাকা থেকে বরিশাল চলে আসলেন।

ঢাকা থেকে যদি রাতের বাসে রওনা দেয়া হয় তবে বরিশাল আসতে আসতে সকাল হয়ে যাবে। বরিশাল রুপাতলি বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেবে আপনাকে। রুপাতলি থেকে কুয়াকাটার প্রচুর বাস পাবেন। অধিকাংশ বাসই মধ্যমানের। রুপাতলিতেই তাদের টিকেট কাউন্টার পেয়ে যাবেন। ভাড়া ২৪০ টাকা করে। নিয়ে যাবে একদম কুয়াকাটায়। বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগে মোটামুটি চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। একমাত্র শীতকাল বাদে বছরের প্রায় সবটা সময় কুয়াকাটায় অফ-সিজন চলে। তাই শীতকালে বাদে যেকোনো সময় গেলে হোটেল ভাড়ার ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন নিঃসন্দেহে।
কুয়াকাটায় আমার দেখা অন্যতম দুটি ভালো হোটেল “পর্যটন মোটেল” আর “হোটেল মোহনা”। পিক সিজনে এসব হোটেলের ভাড়া ২,০০০-২,৫০০ টাকা হয়ে থাকে। আর অফ-সিজনে এক রুমের ভাড়া কমে নেমে আসে ১,২০০ টাকায়। পর্যটনের এক রুমে অনায়াসেই চারজন থাকা যায়, মোহনায় দুই-তিন জন আরামে থাকতে পারবে। মানে হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

কুয়াকাটা মূল বাজারের ঠিক সামনেই বিশাল গর্জনরত সমুদ্র হাতছানি দেয়। তবে বাজারের সামনের সৈকতটা আমার কাছে একটু অপরিষ্কার মনে হয়েছে। এর চেয়ে ভ্যান নিয়ে লেবুর চরে চলে যাওয়া ভালো। লেবুর চরে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি ভ্যানে চার জন বসতে পারে, ভাড়া হয় ৩০০ টাকা। আর যদি দুজন যেতে চান সেক্ষেত্রেও যাওয়া যাবে, ভাড়া হবে ১৫০ টাকা। লেবুর চরে শুধু পরিষ্কার সমুদ্র সৈকত বা কুয়াকাটার আসল সৌন্দর্যই পাবেন না, বরং এখানকার বিখ্যাত মাছ ভাজাও খেতে পারবেন। জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে খুব ভালো করে সামুদ্রিক মাছ খাওয়া যাবে এখানে।
লেবুর চর থেকে আবার কুয়াকাটায় ফিরে এসে পরদিন একটা মোটরসাইকেল ঠিক করুন। প্রতি মোটরসাইকেলে ড্রাইভার সহ বসতে পারে ৩ জন। ভাড়া ৪০০ টাকা। মোটরসাইকেলে করে ঘুরে আসুন লাল কাঁকড়ার চর, বৌদ্ধ মন্দির আর কুয়াকাটা নামের উৎপত্তিস্থল স্থানীয় এক পবিত্র কুয়া থেকে।
লাল কাঁকড়ার চর অনেক দূরে বলে মোটরসাইকেলে ভ্রমণটা বেশ ভালো লাগবে। মাঝখানে মোটরসাইকেল নিয়ে নৌকাতেও উঠতে হতে পারে। সাগরের পাশ দিয়ে ভেজা বালি মাড়িয়ে যখন মোটরসাইকেলের চাকাগুলো সুস্পষ্ট চিহ্ন রেখে যায় তখন তীব্র গতিতে উড়তে থাকা তারুণ্যের কেশ জানান দেয়, “এই তো জীবন”।

কুয়াকাটায় খাবার দাবারও ভালোই পাওয়া যায়। বাজারের দিকে অনেক খাবার হোটেল আছে। ১২০-১৫০ টাকার মধ্যে খুব ভালো করে দুপুর আর রাতের খাবার খেয়ে নেয়া যাবে। সকাল বেলার নাস্তায় ৫০ টাকার বেশি খরচ হবে না।
কুয়াকাটা বাজারে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বাজারটাও ঘুরে নিন। অনেক বার্মিজ জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। দামও সাধ্যের মধ্যে। মোটামুটি এই ছিল কুয়াকাটার ট্যুর পরিকল্পনা। পাঠকের সুবিধের জন্য সকল খরচাদি নিচে দিয়ে দিলাম-

১. ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা= ৫০০+৫০০ টাকা
২. বরিশাল-কুয়াকাটা-বরিশাল= ২৪০+২৪০ টাকা
৩. জনপ্রতি হোটেল ভাড়া (২ রাত)= ৮০০ টাকা
৪. খাবার খরচ (৭ বেলা) = ৩৫০+৩৫০+৫০ = ৭৫০
৫. লেবুর চরে যাতায়াত+মাছ ভাজা= ৭৫+২০০ টাকা
৬. মোটরসাইকেল ভাড়া= ২০০ টাকা

মোট = ৩,৫০৫ টাকা অর্থাৎ ৩,৫০০ টাকাতেই খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে আপনার কুয়াকাটা ভ্রমণ। আগেই বলেছি কুয়াকাটা বাজারের পাশের যে সৈকতটি সেটি একটু নোংরা থাকে। তাই সচেতন পর্যটক হিসেবে স্থানীয়দের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পর্যটন কেন্দ্রের বিষয়টা কানে দিয়ে আসুন আর ব্যক্তিগতভাবে পর্যটন স্থান হিসেবে সৈকতে ময়লা ফেলা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। ভ্রমণ হোক সুন্দর, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ।
ফিচার ইমেজ– লেখক