প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোকে আমার বরাবর টাইম ট্রাভেলের কোনো মেশিনের মতো মনে হয়। কেমন মুহূর্তেই আমাদের পৌঁছে দেয় অতীত দুনিয়ায়। অতীতের সাথে বর্তমানের এক শক্তিশালী যোগসূত্র হিসেবে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। মন্দির, মসজিদ, জমিদারবাড়ি আর রাজপ্রাসাদ তো আর কম নেই আমাদের এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশে। তাই মনে মনে পরিকল্পনা করলাম, আশেপাশে যতগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক কীর্তি আছে তার সবগুলোয় হানা দেব। নতুন কেনা ক্যামেরারও সদ্ব্যবহার হবে তাতে।
কোথা থেকে শুরু করা যায়? ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, বাগেরহাটের দিকে আমার কখনো সেভাবে যাওয়া হয়নি। অথচ বাগেরহাট শহরটিকেই ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর মর্যাদা দিয়েছে। এ এক বিরল ব্যাপার। তখন শরৎকাল, আকাশে পেঁজা তুলোর মতোন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে অলসভাবে। নীল আকাশ- কী এক গভীর মায়া লুকিয়ে আছে দিগন্তবিস্তৃত সেই নীলের মাঝে। ছবি তোলার সুবর্ণ সময় এখন।
আমি পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড থেকে বাগেরহাট গামী বাসে উঠে বসলাম। তীব্র গতিতে ছুটে চলল বাসগুলো। ঘণ্টা দেড়েক পরে নেমে পড়লাম বাগেরহাট ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে। মূল রাস্তার সাথেই ষাটগম্বুজ মসজিদের অবস্থান। আমরা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। লাল ইটে বাঁধানো পরিচ্ছন্ন যাত্রাপথের দুপাশে নানা সাইনবোর্ড লাগানো। সেগুলো আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে বাগেরহাটের ঐতিহ্য সংস্কৃতিসহ আরো বহুবিধ তথ্য।
সবকিছুর সাথে মিশে থাকা একটি সুপ্রাচীন গাম্ভীর্য আপনাকে স্বাগতম জানাবে বহু প্রাচীন এক মসজিদ প্রাঙ্গণে। মসজিদের আগেই ডানহাতে পড়বে একটি জাদুঘর। খান জাহান আলীর বসত ভিটা খননে পাওয়া তার তলোয়ার, প্রকাণ্ড মাটির মাত্র, থালাবাসন, নকশা করা ইটের দেখা মিলবে সেখানে। খান জাহান আলীর মসজিদের বিখ্যাত কুমির কালাপাহাড়ের মৃতদেহকে স্টাফ করে রাখা হয়েছে সেখানে। তারও দর্শন পাবেন একেবারে ঢোকার মুহূর্তে।
ষাট গম্বুজ মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্য রীতি এবং ইতিহাস থেকে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে খান জাহান আলীই এর নির্মাতা। খুব যত্ন করে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এতে ব্যবহৃত পাথরগুলো আনা হয়েছিলো রাজমহল থেকে। নির্মাণ কৌশলীতে তুঘলকি আর জৈনপুরী ছাপ স্পষ্ট।
প্রকাণ্ড এই মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে অর্থাৎ লম্বায় বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা। আর পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ চওড়ায়ও মানানসই, বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট। আর দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে ১০টি মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং এতে সুন্দর কারুকাজ রয়েছে। মূল মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে মিহরাবটি একটি ছোট দরজা দিয়ে প্রতিস্থাপিত। এটি যে একটি দরবার ভবন ছিল দরজাটি তারই প্রমাণ। এই দরজা দিয়ে খান জাহান আলী দরবার ভবনে প্রবেশ করতেন। এখানেই দরবার কাজ পরিচালনা করতেন। আবার নামাজের সময় হলে সবাই এখানেই নামাজ সেরে নিতেন।
মসজিদের বাকি তিন দিকের দেওয়ালে অনেকগুলো করে দরজা রয়েছে। মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে রয়েছে ১১টি বিরাট আকারের দরজা। প্রত্যেকটি দরজাই খিলানবিশিষ্ট। এদের মধ্যে মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার আছে। সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। এই দুটি মিনারের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। এদের একটির নাম রওশন কোঠা, অপরটির নাম আন্ধার কোঠা। এখান থেকে আজান দেবার ব্যবস্থা ছিল। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এই পিলারগুলো ধরে রেখেছে মসজিদের ছাদকে।
প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, সাথে লোহার কিলক দিয়ে জোড়া লাগানো। তবে ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। নামকরণ নিয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদ নিয়ে একটি ধোঁয়াশা আছে। কারণ নামে ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়। বরং তার চেয়ে সতেরটি বেশি- ৭৭টি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের সাত গম্বুজ এবং তা থেকে ষাটগম্বুজ নাম হয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০টি প্রস্তর নির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।
গম্বুজগুলো দুটি রীতিতে নির্মিত। এদের মধ্যে ৭০টির উপরিভাগ গোলাকার। আর পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো। মসজিদ দেখে শেষ করে আমরা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি। প্রবেশপথের দুপাশে কয়েকটি অজ্ঞাত কবর, খান জাহান আলীর সঙ্গীদের কারো হবে হয়তো। কয়েকটি বাগান বিলাস ফুলের ফুল ভর্তি শাখা সেই অচেনা কবরের মাটি ছুঁইছুঁই হয়ে দুলছে। যেন তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে, শান্তির ঘুম।
আমি এবার মসজিদের পেছনের দিকে গেলাম। যেতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। দিঘীর পাড় লোকে লোকারণ্য। আজ নৌকা বাইচ দীঘিতে। জোর প্রস্তুতি চলছে। এগারটায় বাইচ। বারে বাহ! নিজেকেই মনে মনে পিঠ চাপড়ে দিলাম। আজ রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই চলবে। অবশ্য আমার একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো। দিঘীর পানি এখনো নিস্তব্ধ। ছোট ছোট কয়েকটি নৌকায় কয়েকটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে তীরের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাইচের জন্য যেগুলো লড়বে সেগুলো কই? আর দিঘী যতই বড়ই হোক না কেন, যে কোনো বাইচের জন্য তা অপর্যাপ্ত। কয়েক মুহূর্ত পরে আমার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হলো। ভ্যানগাড়িতে করে ছোট ছোট পনের-ষোল হাত লম্বা নৌকা নিয়ে আসছে মানুষেরা। বুঝলাম এই স্পেশাল নৌকাগুলো দিয়ে আয়োজন হবে বাইচের। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যায় অনেকগুলো বাস। এর মধ্যে রয়েছে বনফুল, আরা, বলেশ্বের, হামিম, দোলা। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পাবেন হানিফ, সোহাগ আর ইগলের মত গাড়িগুলো। এগুলো আপনাকে পৌঁছে দেবে বাগেরহাট শহরে। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন ষাটগম্বুজ মসজিদে।
এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে করে যেতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে খুলনা রেলস্টেশনে। তারপর সোনাডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড থেকে কিংবা রূপসা ঘাট পার হয়ে বাসে সোজা ষাটগম্বুজ মসজিদ।
Feature Image: Amitav Aronno