চারদিকে বরফে ঢেকে আছে আর তার উপর দিয়ে দশ হাজার ফুট উচ্চতায় ক্যাবল কার আপনাকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে প্রবল বেগে। কেমন শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা হবে ভাবতে পারছেন? বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশ হওয়ায় বরফের সাথে আমাদের সখ্যতা নেই- ফ্রিজের বরফ আর দোকানের আইসক্রিম বাদে। অন্যদিকে এদেশে পর্বত বলতে কিছুই নেই। তাই বরফ দেখা আমাদের ভাগ্যে হয়ে ওঠে না।
কিন্তু তাই বলে মন তো আর বাঁধ মানবে না। এই জলাজঙ্গলের দংগলের মানুষেরও একটু বরফে গড়াগড়ি করতে ইচ্ছা হতে পারে। কিন্তু সে জন্য আগে ফেলতে হবে কড়ি, তারপরেই মিলবে তেল। সে কড়ি ট্যাঁকে থাকুক আর নাই থাকুক, জায়গাগুলো সম্পর্কে জেনে আসতে দোষ কী? চলুন তাহলে আজ তেমনই একটি বরফে ঘেরা পর্যটনক্ষেত্র ঘুরে আসা যাক কল্পনার চোখে। জায়গাটির নাম অলি আর তার অবস্থান ভারতের উত্তরাখণ্ডে।

উত্তরাখণ্ড ভারতের উত্তরাঞ্চলের একটি রাজ্য। এর চারপাশে রয়েছে দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্য। দিল্লি থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে এই উত্তরাখণ্ডের মধ্যেই পড়েছে জায়গাটি। ৫৪,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজ্যটির আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে- তা হলো এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির তাদের নিপুণ কারুকাজ নিয়ে। কিন্তু মন্দিরগুলো থাকতে লাগুক, আমরা না হয় আজ অলি থেকেই ঘুরে আসি।
আমাদের কাছে কাশ্মীর, গোয়া বা পুরীর সমুদ্র সৈকতের মতো ‘অলি’ এতটা জনপ্রিয়তা না পেলেও ভারতে এবং বহির্বিশ্বে এটি খুবই জনপ্রিয় একটি পর্যটন ক্ষেত্র। আর আবেদন তার দিগন্ত বিস্তৃত বরফে মোড়া পাহাড় আর সুউচ্চ কেবল কারের জন্য। শুধু কি তাই? এখানে রয়েছে পাহাড়ি উপত্যকায় বিস্তৃত ওকের বন। আছে বিশ্বের সব থেকে বড় কৃত্রিম হ্রদ। এটি মূলত স্কিইংয়ের জন্যেই তৈরি করা হয়েছিল নন্দ দেবী পর্বতের উপত্যকায়। বরফ ঢাকা পাহাড়ের ঢাল আর চারপাশের সৌন্দর্য ক্রমাগত ডেকে নিচ্ছে স্কিইং-পাগলাদের।

এখানে আছে আদি শংকরাচার্যের তৈরি জোশী মঠ আর অতি অবশ্যই সেই বিখ্যাত ক্যাবল কার। এটি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যাবল কার লাইন। প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা। জোশী মঠ থেকে অলি পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু দিয়ে চলে গেছে এই ক্যাবল-লাইন।
যখন পূর্ণ বেগে ছুটে চলে ক্যাবল কার, গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। আপনার উচ্চতা ভীতি থাকলে অবশ্য তা হতে পারে সাক্ষাৎ বিভীষিকার মুখোমুখি হওয়ার সমান। আর আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হন, তাহলে তো কথাই নেই- আপনি নিশ্চিত থাকুন এটি হতে যাচ্ছে আপনার জীবনের অন্যতম সেরা ভ্রমণ।
ক্যাবল কার ছেড়ে যায় জোশীমঠ থেকে অলির দিকে। আপনি এতে চড়তে চাইলে বিকেল ৪টা বেজে ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাতে হবে কেবল কার পয়েন্টে। কারণ তখনই দিনের শেষ যাত্রা শুরু হয়। আর সকাল সকাল যেতে চাইলে সকাল ৯টার মধ্যে হাজির হলেই হচ্ছে। জোশীমঠ থেকে অলির ভাড়া ৩৫০ রুপি। ২৫ জন হলেই যাত্রা আরম্ভ হবে তবে ১৫ জন হলেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। আর যাত্রী কম থাকলে ৫-৭ জন হলেই অনেক সময় যাত্রা আরম্ভ হয়।
আপনার কাছে ভারী ব্যাগ থাকলে গুণতে হবে অতিরিক্ত ১০০ রুপি। কিন্তু সে দুঃখ আপনি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে যাবেন, যখন পায়ের তলায় থাকবে বিস্তৃত বরফের রাজত্ব।

অলির কাছেই তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে গুর্স বাগয়াল। এটি ট্র্যাকিংয়ের জন্য বিখ্যাত। ওক, বার্চ, পাইন, কনফেরি গাছের সবুজ সামিয়ানার নিচে বসন্তকালে সমস্ত এলাকাটি একটি সবুজ ঘাসের কার্পেটে রূপান্তরিত হয়। আর শীতকালে তার রঙ হয়ে যায় তুষার ধবল। গুর্স বাগয়াল থেকে অল্প কিছু দূরে রয়েছে ছত্রকুন্ড নামে একটি হ্রদ। তার আশ্চর্য নীল জল আপনার মনকে করে তুলবে বিমোহিত। আর নির্জন চেনাব হ্রদ- সেই বা রুপে গুণে কম কীসে?
অলিতে কখন যাবেন তা নির্ভর করে আপনি কেন যাচ্ছেন তার উপর। তুষারপাত এবং স্কিইংয়ের যদি আপনার লক্ষ্য হয় তাহলে আপনার জন্য সব থেকে ভালো হবে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি- এই চার মাস। মে-জুন মাসের দিকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে সবুজে ঢেকে যায় চারিধার। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শীত আবার রাজত্ব করা শুরু করে। মধুচন্দ্রিমার জন্য মানুষেরা এ সময়টাই বেছে নেয়। কেন কে জানে?

কীভাবে যাবেন?
আপনি ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন বা এয়ারে করে কলকাতা যেতে পারেন। আবার আপনি যদি চান তাহলে সরাসরি ঢাকা থেকে এয়ারে দিল্লী চলে যেতে পারেন। অন্যদিকে কলকাতা থেকে ট্রেন বা এয়ারে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রথমে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে যেতে হবে দেরাদুন স্টেশনে। মনে রাখবেন একটি দীর্ঘ সফর হতে যাচ্ছে এটি। সময় লাগবে ৩২-৩৩ ঘণ্টা। যদিও এসি কিংবা নন এসি দুই রকম সিটই পাবেন, তাই আরামেই যেতে পারবেন।
দেরাদুনের আগে পড়বে বিখ্যাত হরিদ্বার। হিন্দুদের খুব পবিত্র তীর্থস্থান এটি। আপনি চাইলে এখানে নেমে দেখতে পারেন ভারতের অন্যতম প্রাচীন জায়গাটি। আর দেরাদুনে নামলে পরবর্তী গন্তব্য জোশীমঠ। এদের মধ্যকার দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটারের মতো। যেতে পারবেন বাস কিংবা প্রাইভেট কারে করে। আর সময় লাগবে সাত থেকে আট ঘণ্টা।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই ভালো হবে যদি আপনি ওখানেই একটি হোটেল রাত কাটিয়ে ঝরঝরে হয়ে নেন। তারপর পরদিন সকালে কেবল কারে জোশীমঠ থেকে অলিতে।
পথিমধ্যে খরচের একটি আনুমানিক হিসেব দিচ্ছি। তবে দিনকাল যা পড়েছে তাতে খরচ কিছু বাড়লে কিন্তু দোষ দিয়েন না আবার।
ঢাকা থেকে কলকাতা
এসি বাস বা ট্রেনে- ২,০০০ টাকা।
ননএসি বাসে গেলে ১,২০০ টাকা
কলকাতা থেকে দিল্লী
ট্রেনে এসি ৩,০০০ রুপি,
নন এসিতে ১,১০০-১,৫০০ টাকা।
কলকাতা থেকে হরিদ্বার
ট্রেনে ননএসি স্লিপার ৬০০-৭০০ রুপি
থ্রি টিয়ারে ১,৮০০-২,০০০ রুপি পড়বে।
Feature Image: utazom.com