পাহাড় আর আমাকে নিয়ে ঘরে বাইরে বেশ বাজে রকমের কিছু কথা প্রচলিত আছে। অবশ্য থাকবেই বা না কেন? কোনো রকমের ছুটি পেলে আর সেই ছুটি যদি নিজের মতো করে কাটানোর সুযোগ পেয়েই যাই, তো কোনো দিকে না তাকিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো ভাবনা না ভেবে আমি এক ছুটে কোনো না কোনো পাহাড়ে ছুটে যাই। আগে যেতাম বান্দরবানের কোনো পাহাড়ে আর আজকাল ভারতের নানা রকমের, রঙের, ঢঙের বৈচিত্রপূর্ণ পাহাড়ের সাথে পরিচিত হবার পর থেকেই ওদিকের কোনো না কোনো পাহাড়ে ছুটে যাই।
যেমন ছোট কোনো ছুটি পেলেই দার্জিলিং আর বড় কোনো ছুটি পেলে কখনো কাশ্মীর, কখনো লাদাখ, কখনো গোমুখ বা কখনো নৈনিতালের কোনো না কোনো পাহাড়ি শহর, গ্রাম বা নির্জনতায়। পাহাড়ের কাছ থেকে যতটা সুখ, আনন্দ আর অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় আর কোনো কিছু থেকে তা পাওয়া যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে। যে কারণে কেউ কেউ পাহাড় প্রেমী বলে, কেউ বলে পাহাড়ের সাথে পরকীয়া আর আমার ঘরের লোক আরও এককাঠি এগিয়ে গিয়ে পরকীয়ার নোংরা শব্দটা আমার ক্ষেত্রে বসিয়ে দেয়। এতে আমার অবশ্য কখনো কোনো আপত্তি থাকে না। আমি মনে মনে বরং একটু-আধটু খুশিই হই।

দূরে তাকে দেখা এক ঝলক। ছবিঃ লেখক
তো এই পাহাড়কে যতই ভালোবাসি না কেন, যতই পাহাড়ের প্রেমে মশগুল থাকি না কেন, একটা জায়গায় এসে একটা অন্য রকম প্রকৃতি টান কখনো কখনো পাহাড়কেও ছাড়িয়ে যায়। যদি কখনো পাহাড়ের মাঝে, ভাঁজে বা খাঁজে তাকে দেখতে পাই, তো কোথা থেকে কী যেন হয়ে যায় আমার আর আমাদের। তাকে দেখা মাত্র কোনো কিছুই আমাদেরকে আর আটকে রাখতে পারে না। এমনকি ভীষণ প্রিয় পাহাড় পর্যন্ত তার কাছে পরাজিত হয়ে যায় মুহূর্তেই। যদিও পাহাড়ের তেমন কোনো আপত্তি থাকে না তার কাছে পরাজিত হতে সেটা বেশ জানি।
কারণ সে তো পাহাড়েরই আর এক অন্যরূপ। পাহাড় থেকেই তো তারও সৃষ্টি। তাই পাহাড় জানে সাময়িকভাবে বা আপাত দৃষ্টিতে পাহাড়ের পরাজয় মনে হলেও আসলে ওটা পাহাড়েরই একটা অন্যরকম জয়, আনন্দ আর গোপন উচ্ছ্বাস। তাই যতই পাহাড়ে যাই না কেন, সব সময়, মনে-মনে আর চুপিচুপি পাহাড়ের ভাঁজে-ভাঁজে, খাঁজে-খাঁজে আর বাঁকে-বাঁকে তাকে খুঁজি, খুঁজতেই থাকি। আর একবার তাকে দেখতে পেলে, তার চোখে চোখ পড়লেই পাহাড়ে আসার সুখ, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস যেন বহুগুণ বেড়ে যায় নিমেষেই।

ইয়েস, পেয়ে গেছি তার দেখা! ছবিঃ লেখক
তো এবার বছরের শেষ ভ্রমণে, প্রায় ১২ দিনের অপরিকল্পিত ভ্রমণে শেষ পর্যন্ত সেই পাহাড়কেই বেছে নেয়া হলো। তবে একদমই নতুন একটা পাহাড়ি গন্তব্যে যাবো বলে। উত্তরখণ্ডের নৈনিতাল, ভিমতাল, কৌশানী, মুন্সিয়ারির দিকে। তো কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে নৈনিতাল যাবার দীর্ঘ পথেও তার দেখা পাওয়া গেল না সেভাবে। অবশ্য খোঁজাও হয়নি তাকে কোনো সমতলে। কারণ পাহাড়ে গেলেই তার কথা বেশি মনে পড়ে, তাকে বেশি বেশি খুঁজে থাকি। যে কারণে দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ হয়ে যখন উত্তরখণ্ডের শৈল শহর নৈনিতালে প্রবেশ করলাম, তখন থেকেই মনে মনে তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না।
এমনকি নৈনিতাল আসার পথেও কোথাও কোনো পাহাড়ের ভাঁজে, খাঁজে বা বাঁকে তার দেখা পাওয়া যায়নি। অবশ্য তখনও তার অভাব ততটা অনুভুত হয়নি। যতটা তাকে অনুভব করেছি পরদিন নৈনিতাল থেকে মুক্তেশর যাওয়া-আসার পথে। অবাক হয়েছিলাম বেশ। এতটা পাহাড় পেরিয়ে এলাম অথচ তার দেখা পাওয়া গেল না একবারও। এমন তো আগে কখনো হয়নি। তবে কি পাহাড়ের এই অঞ্চলে, উত্তরখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলে তার অবস্থান নেই? কী জানি, হতেও পারে। অথচ দুইমাস আগে দেরাদুন থেকে মুশৌরি হয়ে উত্তরকাশী যেতে আর উত্তরকাশী থেকে গাঙ্গোত্রীর পুরো পথের সবটুকু জুড়েই তো সে ছিল। বেশ অবাক হয়েছিলাম তাই তার দেখা না পেয়ে।

নৈনিতাল থেকে আলমোরার পথে… ছবিঃ লেখক
অবশেষে দ্বিতীয় দিন। নৈনিতাল থেকে কৌশানি যাবার পথে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরে প্রথমবার তার দেখা পাওয়া গেল পাহাড়ের খাঁজে। আর তাকে দেখেই সবার সে কি উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর উন্মাদনা। তাকে এক ঝলক দেখা মাত্র সবাই তার কাছে ছুটে গিয়ে তার স্পর্শ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের রুক্ষতা, উচ্চতা আর পাথুরে বাঁধা খুব সহজেই তার কাছে পৌঁছানোর কোনো পথ খুঁজে পেতে দিচ্ছিল না।
যে কারণে সবাই অনেকটা অস্থির হয়ে উঠেছিল তার কাছে যাওয়ার জন্য, তাকে কাছে পাওয়ার জন্য, তার শীতল স্পর্শ পাওয়ার জন্য, তার কাছে গিয়ে চুপ করে বসে থেকে তাকে অনুভব করার জন্য। তার আনন্দের উচ্ছল ছুটে চলা উপভোগ করার জন্য। অনেক অপেক্ষার পরে, বেশ খুঁজে খুঁজে, অনেকটা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে, আরও প্রায় ৩০ মিনিট চলার পরে অবশেষে তার কাছে যাওয়ার একটা পথ খুঁজে পাওয়া গেল।

তার দেখা পাওয়া। ছবিঃ লেখক
কোনোরকম দ্বিধা না করে মুহূর্তেই গাড়ি থামিয়ে এক ছুটে তার কাছে চলে গেলাম সবাই। এ কী যে এক আকর্ষণ বলে বোঝানো মুশকিল। তার কাছে গিয়ে, নির্মল আর স্নিগ্ধ রূপ দেখে সবার চোখে-মুখে দারুণ এক খুশির ঝিলিক দেখা গেল। সবাই তাকে কাছে পেয়ে দারুণ আনন্দিত আর আপ্লুত, উচ্ছ্বাসে যেন ভেসে যেতে চাইছে তার চলার পথে। কী যে দারুণ কিছু সময় কাটিয়ে ছিলাম সবাই মিলে, নাম না জানা সেই প্রেয়সীর পাশে, বলে বা লিখে বোঝানো মুশকিল। স্মৃতির বুক পকেটে তার স্মৃতি, তার ছবি, তার হাসি, তার চলার ছন্দ অনন্তকাল আনন্দ আর আনন্দ দিয়ে যাবে।
নাহ, সে আর কেউ নয়। সে হলো নাম না জানা…
এক পাহাড়ি নদী। যে কোনো সময়ে পাহাড়ে গেলে যে কোনো পাহাড়ি নদী আমাদেরকে এমনভাবেই টানে, আকর্ষণ করে রাখে, মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে, তার কাছে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়, অনন্ত সময়ের জন্য।

সবুজ জলের উচ্ছ্বাসে। ছবিঃ লেখক
পাহাড়ি নদী, পাহাড়ের এক অন্য আকর্ষণ।