রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত খুলনা শহরটি বসবাসের জন্য একটি আদর্শ শহর। যানজটহীন মুক্ত বাতাসের শহর পেতে হলে চলে আসতে পারেন খুলনাতে। এখানে নাগরিক সুযোগ সুবিধা যেমন পাবেন, তেমনই মিলবে সবুজের দেখাও।
খুলনা জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং দম ফেলার স্থান। আজ আপনাদেরকে সেগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। চলুন দেখে নেয়া যাক “এক নজরে একটি জেলা”– খুলনা।
করমজল
সুন্দরবনে পশুর নদীর তীরে ৩০ হেক্টর আয়তনের একটি পর্যটন কেন্দ্রের নাম করমজল পর্যটন কেন্দ্র। এটি কুমির প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও, এক দিনে সুন্দরবন দেখার আদর্শ জায়গা হিসেবে এর সুনাম রয়েছে। এখানে কুমির প্রজনন কেন্দ্র সহ রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের একটি অংশ দেখা যায়। এখানকার একটি বিশেষ আকর্ষণ হলো রেসাস বানর।
হাদিস পার্ক
হাদিস পার্ক বা শহীদ হাদিস পার্ক খুলনার মূল শহরের ডাকবাংলার মোড় থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে অবস্থিত। এটি খুলনার সর্ব পরিচিত একটি পার্ক। মনোরম পরিবেশ ও ইতিহাসের গন্ধে প্রাণ জুড়াতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে। এখানে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে তৈরি একটি শহীদ মিনার সহ রয়েছে একটি লেক। এছাড়াও এর পিছনের দিকের নগর ভবনটি পার্কের শোভা বর্ধন করে।
রূপসা সেতু
রূপসা নদীর উপর নির্মিত এই সেতুর বর্তমান নাম খান জাহান আলী সেতু। পুরো খুলনার মানুষের কাছে প্রিয় একটি জায়গা এই রূপসা সেতু। বিকেল হলেই এখানে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়, আর তা থাকে রাত অবধি। খুলনায় গেলে আপনি নিশ্চয় এখানকার নির্মল বাতাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রাতের রূপসা ব্রিজ দেখার স্বাদ মিস করতে চাইবেন না।
রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি
খুলনা ও যশোর জেলার শেষ সীমানায় অবস্থিত ফুলতলা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে দক্ষিণডিহি গ্রামের অবস্থান। এখানে রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এখানে রয়েছে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর। এছাড়াও রয়েছে একটি পিকনিক কর্নার। এখানে প্রায় প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকদের আগমন ঘটে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বসতভিটা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বসতভিটা খুলনার পিঠাভোগ গ্রামে অবস্থিত। ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক কবি গুরুর পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটাকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়।
শিরোমণি স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর এ কথা সবারই জানা, কিন্তু যেটা অজানা সেটা হলো খুলনা স্বাধীন হয়েছিল তার এক দিন পর অর্থাৎ ১৭ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এখানে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা “শিরোমণি ট্যাঙ্ক যুদ্ধ” বা “শিরোমণি সম্মুখ সমর” নামেও পরিচিত। আর এই বীরত্বগাথার স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থানের নাম শিরোমণি। খুলনার এই স্থানেই রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধিটি খুলনার নৈহাটি ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামে অবস্থিত। এখানে একই জায়গায় বীর বিক্রম মহিবুল্লার সমাধিও রয়েছে। বর্তমানে দেড় একর জমি নিয়ে এই দুই মুক্তিযোদ্ধার সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
গল্লামারি বধ্যভূমি
গল্লামারি বধ্যভূমি খুলনার সব থেকে বড় বধ্যভূমি। এটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিও স্টেশন ছিল, আর এখানেই মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। স্বাধীনতার পর এখানে অনেক নাম না জানা মানুষের কংকাল পাওয়া যায়। তাই এখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
কবি কৃষ্ণ চন্দ্র ইনস্টিটিউট
এটি খুলনা জেলার দিঘলিয়া থানার সেনহাটি গ্রামে অবস্থিত। কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদার ছিলেন বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য কবি। তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থের নাম, ‘সদ্ভাব শতক’। ১৯১৪ সালে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এখানে নির্মিত হয়েছে এই কবি কৃষ্ণ চন্দ্র ইনস্টিটিউট।
সুন্দরবন হিরণ পয়েন্ট
সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে অবস্থিত হিরণ পয়েন্ট একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। হিরণ পয়েন্ট ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। হিরণ পয়েন্ট একটি অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে অনেক বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি এবং সরীসৃপ রয়েছে। সুন্দরবনে একটি আদর্শ ভ্রমণ করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন হিরণ পয়েন্ট থেকে।
স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাড়ি
স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাড়ি খুলনা জেলায় পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। একে অনেকে ভুল করে জমিদার বাড়িও বলে থাকেন। বাংলাদেশের একজন অন্যতম বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এ বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন।
চুকনগর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও একদিনে এক স্থানে এত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। এখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে।
জাতিসংঘ পার্ক
খুলনার তারের পুকুর বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই, আর এখানেই গড়ে উঠেছে জাতিসংঘ পার্ক। এটি প্রথমে খুলনা শিশু পার্ক নামে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতিসংঘ পার্ক। এটি খুলনা শহরের খান জাহান আলী সড়কের পাশে অবস্থিত।
লিনিয়ার পার্ক
খুলনার ময়ূর নদীর তীরে অবস্থিত এই পার্ক খুলনার সব থেকে বড় পার্ক। এখানে কয়েক কি: মিঃ ওয়াক ওয়ে সহ রয়েছে হাতির ঝিলের ব্রিজের আদলে একটি ব্রিজ। এখানকার মূল আকর্ষণ হলো ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে পুরো খুলনা শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্তমানে ওয়াচ টাওয়ারটি পরিত্যক্ত হয়ে আছে।
প্রেম কানন
নামেই কেমন যেন প্রেম প্রেম গন্ধ আছে, তাই না! জমিদার শ্রীমঙ্গলচাঁদ চুনিলাল একবার বৃন্দাবন গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে শ্রীকৃষ্ণ-রাধার প্রতি প্রেম-ভক্তিতে নিবেদিত হয়ে তাঁদের স্মৃতিতে গড়ে তোলেন ‘প্রেম কানন’ নামের একটি উদ্যান। এটি বাংলা ১৩৩৫ সালে প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয়। এই উদ্যানটি খুলনা শহরের জোড়াগেটে অবস্থিত। এখানে রয়েছে একটি পুকুর, একটি রথ এবং বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ।
বকুলতলা
এটি খুলনা জেলা প্রশাসকের বাসভবনে অবস্থিত। জেলা প্রশাসকের উদার মানসিকতার কারণে সপ্তাহে সাত দিনই এখানে মানুষের যাতায়াত থাকে।
উপরোক্ত জায়গাগুলো ছাড়াও খুলনা জেলায় আরো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে খুলনা রেল স্টেশনের পাশে অবস্থিত মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, খানজাহান আলী কর্তৃক খননকৃত বড় দীঘি, কুয়েট ক্যাম্পাস, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মুজগুন্নি পার্ক, মুজগুন্নি লেক, চরের হাট ত্রিমোহনা, মহিম দাশের বাড়ি, আর্য ধর্ম সভা মন্দির ও খালিশপুর সত্য আশ্রম বেশ জনপ্রিয়।
Feature Image: Riasat Rakin