বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। মনে করা হয়, পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই এর নাম পঞ্চগড়। এখানে অবস্থিত গড়গুলো হচ্ছে ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড়।
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই পঞ্চগড় একটি প্রাচীন জনপদ। এর তিন দিকে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। তাই এখান থেকে নিমেষেই হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এছাড়াও রয়েছে অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। আজ আমি আলোচনা করব প্রাচীন এই নগরীর ঐতিহাসিক স্থানগুলো নিয়ে।
ডাকবাংলো ও পিকনিক স্পট
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় মহানন্দা নদীর তীরে একটি ঐতিহাসিক ডাকবাংলো রয়েছে এবং তার পাশেই উপজেলা পরিষদ নির্মিত একটি পিকনিক স্পট রয়েছে।
জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রিত এই ডাক বাংলোটির নির্মাণ শৈলী অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। এটি কুচবিহারের রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
ডাকবাংলো এবং পিকনিক স্পটটি একটি সুউচ্চ গড় বা টিলার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এখান থেকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। উল্লেখ্য পঞ্চগড় বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা। এর প্রায় তিন দিকেই ভারতের সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত। অর্থাৎ মহানন্দা নদীর এক পাড়ে বাংলাদেশ আর অন্য পাড়ে ভারতের অবস্থান।
শীতের সকালে ডাকবাংলোর উত্তর পাশে দাঁড়ালে দেখা যায় সোনা রোদে ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এটি হিমালয় পর্বতমালার তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।
মির্জাপুর শাহী মসজিদ
এই মির্জাপুর শাহী মসজিদটি পঞ্চগড়ের অটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত। এটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয় বলে জানা যায়, যা ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত মসজিদের সমসাময়িক।
১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের মসজিদ ও মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। তবে এটি কে নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন মির্জাপুর গ্রামেরই এক বাসিন্দা এটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার কারো মতে দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
মসজিদটির মধ্যবর্তী দরজার উপরে একটি ফলক রয়েছে, যেখানে ফার্সি ভাষায় এর নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য লেখা আছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, মোঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের গায়ে টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশা খোদায় করা আছে, যার একটির সাথে অন্যটির কোনো সাদৃশ্য নেই। নির্মাণ শৈলীর নিপুণতা, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও তিনটি গম্বুজ এই মসজিদের মূল আকর্ষণ। মসজিদটি এখন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আয়ত্তে রয়েছে।
বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
হিন্দু পুরাণের স্কন্দ অনুযায়ী, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে দেবী দুর্গার দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে দুইটি খণ্ড পড়েছিল বাংলাদেশে; একটি পড়েছিল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডুতে আর অন্যটি পড়েছিল পঞ্চগড় জেলার বদেশ্বরীতে। সেখানেই চার’শ বা পাঁচ’শ বছর পূর্বে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়।
বদেশ্বরীতে অবস্থিত প্রাচীন এই মন্দিরটিই বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির। মূলত উপমহাদেশের যেখানে যেখানে দেবী দুর্গার শরীরের খণ্ড পড়েছিল সেই জায়গাটিকে পীঠ বলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলানো একটি চার্টে এরকম ৫১টি পীঠ স্থানের উল্লেখ রয়েছে। বদেশ্বরীর এই পীঠে এখনো সংরক্ষিত আছে দেবী দুর্গার গোড়ালি।
বদেশ্বরী মন্দিরটি বোদা উপজেলায় অবস্থিত। অনেকে বলেন, এই মন্দিরের বদেশ্বরী নাম থেকেই এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। আবার কিছু মানুষের ধারণা, এই অঞ্চলে এক সময় অনেক কাদা হতো আর কাদার সমার্থক শব্দ বোদ থেকেই এসেছে বোদা উপজেলার নাম।
বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
ভিতরগড় মধ্য যুগের একটি বিশাল দুর্গনগরী। এটি প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা বাংলাদেশের সব থেকে বড় দুর্গনগরী। এর কিছু অংশ বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে আর কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত।
ভিতরগড় দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে। এ প্রত্নস্থলসমূহ খালপাড়া, প্রধানপাড়া, ছোট কামাত, চুমানুপাড়া, কমলাপাড়া, সেনপাড়া, পেশকার পাড়া, জমাদার পাড়া, বড় কামাত, মেহনা ভিটা ও সিপাহি পাড়া গ্রাম জুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে দীঘি, মন্দির, রাজবাড়ি সহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া এখানে বিভিন্ন আসবাবপত্র সহ দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা এর নির্মাণকাল সম্পর্কে অনুমান করেন যে, এটি প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল।
মহারাজার দীঘি
পঞ্চগড়ের মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এক সময় পৃথু রাজের রাজপ্রাসাদ ছিল। এর পাশেই এখনো বর্তমান রয়েছে একটি দীঘি, যা মহারাজার দীঘি নামে পরিচিত।
পৃথু রাজার খননকৃত এই ‘মহারাজার দীঘি’টি বিশাল আয়তনের একটি পুকুর বা জলাশয়। পাড় সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০*৪০০ গজ। অধিক গভীরতার কারণে দীঘিটির জল অনেক স্বচ্ছ।
বলা হয়, পৃথু রাজা এক দিন কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণীর লোকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। তখন তিনি ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দীঘিতে আত্মহনন করেছিলেন।
প্রতিবছর নববর্ষের সময় ‘মহারাজার দীঘি’র পাড়ে মেলা বসে। উক্ত মেলায় মাঝে মাঝে ভারত থেকেও লোক আসতে দেখা যায়।
গোলকধাম মন্দির
গোলকধাম মন্দিরটি দেবীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত শালডাংগা ইউনিয়নের শালডাংগা গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। সুন্দর কারুকার্যময় এই মন্দিরটির গায়ের শিলালিপি অনুযায়ী জানা যায়, এটি ১৮৪৬ সালে নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি মূলত গোলক কৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই মন্দিরের নামেও তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
গোলকধাম মন্দিরটি ছয় কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। এর স্থাপত্য কৌশল গ্রীক পদ্ধতির অনুরূপ, যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাই এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
বারো আউলিয়ার মাজার
জানা যায়, আটোয়ারী উপজেলার বারো আউলিয়া গ্রামে সুলতানি আমলে ১২ জন আউলিয়ার আগমন ঘটেছিল। এ বারো জন আউলিয়া বর্তমান বারো আউলিয়া গ্রামে দ্বীন প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং এখানেই তারা ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে বারো আউলিয়াগণের সমাধিকে কেন্দ্র করে একটি মাজার গড়ে ওঠে, যা বারো আউলিয়ার মাজার নামে পরিচিত।
বারো আউলিয়ার মাজারকে ঘিরে নানা লোক কথা প্রচলিত রয়েছে, যা তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বারো আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ওরসের অয়োজন করা হয়। এই সময় দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ মাজার জিয়ারতের জন্য ছুটে আসেন।
কিছু কথা:
বছরের সব সময়ই বেড়িয়ে আসতে পারেন পঞ্চগড় থেকে। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে শীতকালে। আর পাহাড়ি নদী মহানন্দা সেজে ওঠে বর্ষাকালে।
Feature Image: priopanchagarh.blogspot.com