গোয়া ভ্রমণে সমুদ্র আর নানা রকম বীচের পাশাপাশি অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট হলো দুর্গ। হ্যাঁ, গোয়া বেশ প্রাচীন এক সমুদ্র তীরবর্তী শহর। যে শহরের সমুদ্রের তীরে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু দুর্গ। পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি সহ নানা সময় নানা রকম শাসনামলের প্রয়োজনে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গড়ে ওঠা নানা রকম দুর্গ। এর মধ্যে আমাদের ভ্রমণসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ফোর্ট এগোনডা বা প্রাচীন দুর্গ দর্শন, নর্থ গোয়া থেকে সাউথ গোয়া যাবার ট্যুরের মধ্যে।
যে কারণে ড্রাইভার এটা সেটা বুঝিয়ে দুর্গে না নিয়ে যাবার একটা পায়তারা করেছিল। বলেছিল এখানে সময় নষ্ট না করে স্নো আইল্যান্ডে বেশী সময় কাটানো যাবে। রাখো মিয়া তোমার স্নো আইল্যান্ড, দরকার হয় যাবো না ওখানে, কিন্তু দুর্গ কিছুতেই মিস করা যাবে না। আর তারচেয়েও বড় কথা সেই দুর্গ তো দূরে কোথাও না। সমুদ্র থেকেই সেই দুর্গ দেখা গেছে, তাহলে পাড়ে এসে কেন ভাওতাবাজি? সাথে আরও একজন গলা মেলাতে দুর্গের পথ ধরলো ড্রাইভার।
ডলফিন পয়েন্ট থেকে গাড়িতে মাত্র ১০ মিনিটেই পাহাড়ের কিছুটা চড়াই পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ১৬১২ শতাব্দীর এক প্রাচীন লাল দুর্গের দুয়ারে। পর্তুগিজরা এটা তৈরি করেছিল মূলত ডাচদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, আরব সাগরের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে। যদিও কালের আবর্তে আর পরিস্থিতির বিবেচনায় এই প্রাচীন দুর্গ কখনো লাইট হাউজ, কখনো জেল, কখনো পানি শোধনাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন যেটা শুধু পর্যটক আকর্ষণ আর মাঝে মাঝে সমুদ্রের লাইট হাউজ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
গোয়ার ৩৮ ডিগ্রী তাপমাত্রায়, লাল ভাঙা ইটের ধুলো ওড়া পথ মাড়িয়ে দুর্গের মূল ফটকে প্রবেশ করতেই, প্রাচীন আমলের কয়েদখানা। যেটা দুর্গের মাঝের অংশ। এর নিচেও রয়েছে বিশাল আরেকটা অংশ যেখানে মূলত পানি শোধনাগার বা পানি সংরক্ষণের কাজ করা হতো, যুদ্ধ বা অন্যান্য সময়ে জাহাজে পানি সরবরাহ করতে। এখনো হয় কিনা জানা হয়নি। তখন আমরা মাটির সমতল থেকে প্রায় একতলার সমান নিচে দাঁড়িয়ে, এর নিচে আছে একাধিক তলা আর উপরে তো আছেই।
নিচের দিকে আর যাওয়ার সুযোগ নেই, নেই সময়ও তেমন। তবে উপরের দিকে যাওয়ার জন্য একই রকম লাল ইটের এবড়ো থেবড়ো পথ রয়েছে। সেদিকে ছুটলাম অল্প সময়ে যতটা দেখে নেয়া যায়। সোজা উপরে উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে, যতটা উপরে ওঠা যায়।
সিঁড়ি শেষ করে খোলা জায়গায় দাঁড়াতেই চমক! লোহার রেলিং দেয়া নিরাপত্তা বেষ্টনির ওপাশে চোখে যেতেই বিস্ময়ে হা হয়ে গেলাম! আরে, পুরো আরব সাগর যে নীল হয়ে আছে নিচের দিকে! হু হু বাতাসে উড়িয়ে নেবার জোগাড়! কোনোভাবেই ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে, নিজেই নিজের মোবাইল দিয়ে ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক; সবাই যাকে সেলফি বলেন আরকি।
অনভ্যস্ত হাতে আঁকাবাঁকা কয়েকটা সেলফি তুলেছি ঠিকই, কিন্তু তাতে আমি তৃপ্ত হতে না পেরে, শেষে পাশের এক জুটির দ্বারস্থ হলাম হিন্দি আর ইংরেজির মিশ্রণে। বেশ, তারা কয়েকটা ছবি তুলে দেয়ায় একটু স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে একটু নিচের নীল সমুদ্র দেখি আর মাতাল করা বাতাস খাই। মাঝে মাঝে এমন করে পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজ উপভোগ করতে কী অপূর্বই না লাগে।
এরপর বেশ ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম, চারদিকের দুর্গের ছবি তুলতে তুলতে। ভালো করে চোখ মেলে তাকালাম প্রথমবারের মতো। আরে এ যে বিশাল এক মাঠের চেয়েও বড় ইট পাথরের ছাদ। নিচে একটা আলাদা উঁচু পাটাতনের মতো, যার উপরে ছোট ছোট বেদী বা গুহার মতো কোনো কিছু। এমনভাবেই করা যে, কোথায় যে শুরু আর কোথায় যে শেষ সেটা বোঝা মুশকিল। শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট ভালো ব্যবস্থা।
সরু ইটের পথ পেরিয়ে নিচের বিশাল পাথরের ছাদ বা লাইট হাউজের আঙিনায় চলে এলাম। সবাই যে যার মতো করে ছবি তোলায় ব্যস্ত। নানা আকার আর প্রকারে। কিন্তু আমার চোখ তখন আর একটু দূরে, ইটের দেয়ালের সাথে সারি সারি মানুষ দাঁড়িয়ে দূরে কী যেন দেখছে? ছুটে সেখানে চলে গেলাম।মানুষের ভিড় ঠেলে আবারো সরু ইটের পথের উপরে দাঁড়িয়ে, ইটের দেয়াল থেকে তাকাতেই দেখি হাওয়ার প্রলেপ লাগলো গায়ে! কোথা থেকে এলো এই গরমে, তপ্ত রোদে হুট করে ঠাণ্ডা হাওয়া? তাকিয়ে দেখি আরে সর্বনাশ এখানেও সমুদ্র! সেই নীল জলরাশি, রাশি রাশি। যত দূর চোখে যায় শুধু নীল নীল আর নীল জলরাশির আধার।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলাম নিচের নীল জলে ছোট ছোট রঙিন পিঁপড়ার মতো ধীরে ধীরে, ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলেছে স্পীড বোট, বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা। দূরে একটা সবুজ দ্বীপে যাচ্ছে ওরা, যেটার নাম হানিমুন আইল্যান্ড। সময়ের অভাবে সেখানে যেতে না পারার আক্ষেপ সাথে করেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
যেটুকু সময় ইট পাথরের ওই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনপ্রাণ ভরে শুষে নিয়েছি, উন্মুক্ত আরব সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য। যা আপনার চোখ, চেতনা আর বোধকে বিলুপ্ত করে দেবে। আপনি অপলক তাকিয়ে থাকবেন সেদিকে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করবে না, কোনো কথা বা শব্দ করতে ভালো লাগবে না, কিছু শুনতে মন চাইবে না।
শুধু ইচ্ছে হবে অপলক তাকিয়ে থাকতে, প্রাণ ভরে নীল জলরাশি ছুঁয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস বুক ভরে নিতে, দুর্গ যে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পাহাড়ের সবুজের দিকে ইচ্ছে হবে হাত বাড়াতে, কখনো ইচ্ছে হবে দুর্গের রুক্ষতা ভেঙে, পাহাড়ের সবুজে গড়িয়ে, সমুদ্রের হাওয়ায় ভেসে, নীল জলে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে, ভেসে-ভেসে, ডুবে-ডুবে, নিজেকে হারাতে।
ফিচার ইমেজ- লেখক
গোয়া ভ্রমণ: রুক্ষ দুর্গে দুর্লভ সমুদ্র!

Loading...