ইট’স জাস্ট ওয়াও! আগ্রা থেকে দিল্লী যেতে মূল শহরের ব্যস্ততা, সিগনাল, হালকা জ্যাম ছাড়িয়ে এক্সপ্রেস হাইওয়েতে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করার পরে, রাস্তার প্রশস্ততা, স্বচ্ছতা, বিস্তার আর একদম সোজা রাজপথ দেখে আমাদের সবার প্রাথমিক অনুভূতির প্রকাশটা এমনই ছিল। অবশ্য শুধু আমাদের কেন, আমাদের মতো দেশ থেকে গিয়ে যে কেউ এই পথের, এই এক্সপ্রেস হাইওয়ের, প্রথম দেখাতেই এমন অনুভূতি প্রকাশ করবে সে বলাই যায়।
আমাদের আগ্রা সফর, মানে আগ্রার জগতখ্যাত স্থাপনা তাজমহল দেখতে আমাদের হাতে সময় ছিল মাত্র একদিন। ওইদিন রাতেই আবার দিল্লী থেকে আমাদের জয়পুরের ট্রেন ছিল আগে থেকেই কনফার্ম করা। যে কারণে আগ্রা থেকে জয়পুর অনেক কাছে হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দিল্লীর উল্টো পথে আসতেই হয়েছিল।

এক্সপ্রেস ওয়ের টোলপ্লাজা। ছবিঃ সংগ্রহ
আগ্রা থেকে দিল্লী প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ। সাধারণত এই পথ পাড়ি দিতে ৫/৬ ঘণ্টার মতো সময় লাগে, পথের অবস্থা আর জ্যামের উপর ভিত্তি করে বা হিসেব করে। যে কারণে আগ্রা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম। ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ধরে রাত ৮টা থেকে ৯টায় দিল্লি পৌঁছে, ১০:৩০ এর জয়পুরের ট্রেন ধরবো বলে।

দিল্লী-লখনৌ এক্সপ্রেসওয়ে। ছবিঃ সংগ্রহ
আমাদের একটা অতিরিক্ত টেনশন ছিল আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। কারণ এর আগের পাঁচ দিনের নানা জায়গায় ভ্রমণে তিনি মাঝে মাঝে এত এত আর এতই ধীরে গাড়ি চালিয়েছেন যে পিছনে সাইকেলের শব্দ শুনলেও তিনি সেই সাইকেলকে বহুবার প্রায় থেমে গিয়েই ওভারটেক করতে দিয়েছেন! যে কারণে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম বৈকি। যে এই লম্বা পথ আসলেই তিনি ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে যথা সময়ে দিল্লী পৌঁছে দিতে পারবেন কিনা? না পারলেই সর্বনাশ। তার উপর এই আগ্রা আসাটা ছিল তার একেবারেই মতের বিপক্ষে, নতুন রুটে। যে কারণে আমাদের শঙ্কা ছিল যে তিনি না আবার ইচ্ছে করেই অনেক ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আমাদের জয়পুর ভ্রমণের ১২টা বাজিয়ে দেন কিনা!
কিন্তু আমরা জানতাম না যে, যে পথে চলতে শুরু করেছি সেই পথে ৮০-১০০ কিলোমিটার এর নিচে গাড়ি চলে না সাধারণত! কারণ এটা এক্সপ্রেস হাইওয়ে। গাড়ির কোনো ঝামেলা না থাকলে বা গাড়ির হুট করে কোনো সমস্যা না হলে এই পথে ধীরে গাড়ি চালানো অসম্ভব। মানে অন্তত ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতেই হবে! বেশ বেশ, আমরা তো এইটাই চাই।
ছয় লেনের এই বিশাল, চকচকে ঝকঝকে আর মসৃণ এক্সপ্রেস হাইওয়ে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। একদম বামের লেন হলো কোনো সমস্যা হলে বা ধীরে চলার বড় বাস ট্রাক বা মালবাহী ট্রাক অথবা বড় আকারের কার্গো টাইপ গাড়ি চলার জন্য। পরের লেন ঘণ্টায় ৮০ বা এই গতির গাড়ি চলার জন্য। তারপরের লেন ৮০-১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলা গাড়ির জন্য। আর একদন ডানের লেন হলো যে কোনো রকম ওভার টেকের জন্য।

এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ত পথ। ছবিঃ সংগ্রহ
উহ সেই লেনের ওভারটেক করা এক একটা গাড়ি মাঝে মাঝেই পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে যাচ্ছিল পুরো শরীরে রোমাঞ্চ জাগিয়ে, কখনো ভয়ে হীম ধরিয়ে দিয়ে আর কখনো মনে আতংক জাগিয়ে!
যে কারণে আমাদের নৌকার মতো গতিশীল গাড়ির চালকও বাধ্য হয়েছে পুরো ২৫০ কিলোমিটার আগ্রা-দিল্লীর পথ ৮০+ কিলোমিটার বা তারচেয়ে বেশী গতিতে গাড়ি চালাতে। এমনকি তিনিও কখনো কখনো তার গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১০০ পর্যন্ত তুলেছেন যা দেখে আমি আর আমরা, আমাদের সবাই বিস্মিত হয়েছি!
আর এই পথের দুই পাশের প্রকৃতিও বেশ একটু অন্য রকম। কোথাও মাইলের পর মাইল বিরান ভূমি, কোথাও নানা রকমের বিশাল বিশাল স্থাপনা বা শিল্প কারখানা, কোথাও কিছু আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ আর কোথাও বিস্তৃত কৃষি ভূমি। পুরো পথের মাঝে রয়েছে অনেকগুলো টোল প্লাজা নির্ধারিত দূরত্ব পরপর। টোল প্লাজার প্রায় সাথেই লাগানো আছে পথ চলতি মানুষদের জন্য নানা রকম আয়োজন। পর্যাপ্ত ওয়াশরুম, চা-কফি আর স্ন্যাক্সের জন্য দোকান। অল্প সময়ের আড্ডাস্থল সহ নানা রকম আয়োজন। যেন যে কারো, যে কোনো প্রয়োজন তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই মেটাতে পারে নির্ধারিত আর সহনীয় পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে।

গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার! ছবিঃ সংগ্রহ
এমন একটা জায়গায় থেমে আমরা ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে চা আর কফি উপভোগ করেছিলাম। কিছুটা সময় বসে আর দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি দূর করেছিলাম। আর অবাক হয়ে আলোচনা করছিলাম যে আমাদের নিদারুণ ধীর গতির ড্রাইভারও ঠেলায় পড়ে কী দারুণ গতিতেই না গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে এই এক্সপ্রেস হাইওয়ে কিন্তু অন্যান্য পথের মতো ফ্রি নয়। মাঝে মাঝেই বেশ বড় আকারের টোল দিতে হয়েছে ড্রাইভারকে।
তবে ড্রাইভার একটা অবাক করা তথ্য দিয়েছিল। সেটা হলো, আমরা ভেবেছিলাম এই এক্সপ্রেস হাইওয়ে বোধহয় আগ্রা থেকে দিল্লী বা দিল্লী থেকে আগ্রা যাওয়ার জন্যই তৈরি করা, কিন্তু না তিনি জানালেন, এই দীর্ঘ আর প্রশস্ত এক্সপ্রেস হাইওয়ে আগ্রা থেকে চলে গেছে সুদূর লখনৌ পর্যন্ত। মানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেস হাইওয়ে! ভাবা যায়, সত্যি অবাক হয়েছি এই তথ্য জেনে। আর সবাই একই সাথে বলে উঠেছিলাম… ওয়াও!

পথের শুরুতে। ছবিঃ সংগ্রহ
আসলেই এই পথে নতুন যারা যাবে, দীর্ঘ এই আগ্রা থেকে লখনৌ এক্সপ্রেস হাইওয়েতে গাড়ির গতির রোমাঞ্চকর স্বাদ পেলে আমাদের মতো ধীর গতিতে চলমান দেশের যে কেউ নির্দ্বিধায় বলে উঠবে ওয়াও! আসলেই, আগ্রা-দিল্লীর এই এক্সপ্রেস হাইওয়ে একটা ওয়াও জার্নি উপহার দিয়েছিল আমাদের। সবাই দারুণ খুশি হয়েছিলাম এমন দ্রুত গতির রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়ে।