দীর্ঘ অপেক্ষার এমবিএর সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম। কোথাও না কোথাও যেতে হবে আমাকে। যেতেই হবে। কিন্তু যাবার জন্য তেমন কাউকে খুঁজেও পেলাম না সঠিক সময়ে। যে কারণে একদিন একা একাই বেরিয়ে পড়লাম নতুন কিছুর সন্ধানে। রাত ৯:০৫ এ বাসা থেকে বের হলাম কমলাপুরের উদ্দেশ্যে। কমলাপুর গিয়ে দেখি, আমার এক কলিগ তার এক বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়! এক থেকে তিন হয়ে গেল।
ডলফিন পরিবহনের বাসে উঠে বসলাম। এক টানে কুমিল্লায় রাত দুইটায়। কুমিল্লা থেকে বাস ছাড়ল ৩০ মিনিটের বিরতির পর।
পিছনের সিটের একজন জিজ্ঞাসা করলো, আপনারা বান্দরবানের কতদূর যাবেন?
ঠিক জানি না, যতদূর যেতে পারি বা যেতে দিচ্ছে ততদূর, আমাদের উত্তর।

অপরূপ বান্দরবান। ছবিঃ সংগ্রহ
আমরা তিনজন
আপনারা?
আমরাও তিনজন।
তাহলে চলেন একসাথে যাই, যতদূর যাওয়া যায়, কী বলেন? সহযাত্রীদের আহ্বান।
ঠিক আছে তাহলে, আমরা ছয়জন হলাম, সবাই হাত মেলালাম, পরিচিত হলাম, ওরা তিন বন্ধু, আল-আমিন, মিতুল আর প্লাবন।
সকাল ৭টায় বাস থেকে নামলাম। বাস থেকে নেমেই সোজা রুমা বাস স্টপে গেলাম। নাস্তার টেবিলে একজনের প্রশ্ন, ভাই এখন কি সাকা যেতে দিচ্ছে?
ঠিক জানি না ভাই। আমারও সেই লক্ষ্য নিয়েই এসেছি, দেখাই যাক না কতদূর যাওয়া যায়? অন্য একজনের উত্তর।
টিকিট কাটবো, এমন সময়, একজন জানতে চাইল ভাই, আপনাদের সাথে কি আমরা যেতে পারি? আমরা প্রথম বান্দরবান এসেছি।
অবশ্যই, আপনারা কয়জন?
আমরা চার বন্ধু, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
ঠিক আছে চলেন, একসাথে টিকিট কাটি। ছয় আর চার, দশ জনের বেশ বড় একটা টিম হয়ে গেল।
পিয়াল, সামি, তৌহিদ আর হাংরি! (বন্ধুদের দেয়া নাম)। সবাই মিলে বাসে উঠলাম।

পাহাড়ি বাঁকা পথে। ছবিঃ সংগ্রহ
বান্দরবান থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত যেতে যেতেই আগের রাতের জার্নির সকল ধকল মুছে গেল সবার। চারদিকের নির্মোহ সবুজের হাতছানি, সমতলের পিচ ঢালা পথ ধীরে ধীরে পাহাড়ি উঁচুনিচু পথের দিকে উঠে যাচ্ছে। যারা সমতলে থাকে একটু উঁচুনিচু আর আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলানো পাহাড়ি পথ দেখলেই তাদের আনন্দ যেন বাঁধনহারা হয়ে ওঠে। যে কারণে আমাদের সবাই-ই দারুণ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে লাগলো, পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে আর ঢেউ খেলে যাওয়া রাস্তার দোলায়। এক একটা বাঁক আসে আর এক এক জনের উচ্ছ্বসিত চিৎকারে কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা।
কারণ ওরা এবারই প্রথম এসেছে বান্দরবানে। এবারই প্রথম দেখছে এত এত সবুজের সমারোহ। এবারই প্রথম চলেছে এমন পাহাড়ি ঢেউ খেলানো পথে। সুতরাং এমনটা ওদের হতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক। স্পষ্ট মনে আছে আমার, আমিও যখন প্রথম বান্দরবানে আসি আমারও ঠিক এমনটাই হয়েছিল, ঠিক একই রকম অনুভূতি আমাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, ঠিক একই রকম উচ্ছ্বসিত চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছিলাম আমিও। সুতরাং নতুন ছেলেগুলোর মাঝে সেই পুরনো উচ্ছ্বাস দেখে একটুও বিরক্ত লাগেনি, বরং কখনো নিজেরও ইচ্ছা হয়েছে ওদের সাথে গলা মেলাতে, চিৎকার করতে, বাসের ছাদে উঠে গলা ছেড়ে গান গাইতে। কিন্তু আগে বেশ কয়েকবার এমন পাগলামি করেছি বলেই এবার নিজেকে সামলে নিলাম নিজের কাছেই।

মায়াবী সবুজের টানে। ছবিঃ সংগ্রহ
আমাদের বেশ ছোট্ট বাসের ভীষণ ছোট সিটে কোনোরকমে গায়ে গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছি এক একজন। এই ক্ষেত্রে যেটা সব সময়ই ঘটে থাকে এখানেও তাই-ই ঘটতে শুরু করলো অনেকটা। যেহেতু একটি সিটের সাথে জানালা একটাই থাকে আর সেই জানালার পাশে দুজন যেহেতু বসার কোনো অলৌকিক উপায় নেই, সেহেতু মাঝে মাঝেই দুই সিটের দুজনের সাথে খুনসুটি লেগে যাচ্ছিল একজন পাহাড় দেখতে পাচ্ছে, সবুজ ছুঁয়ে দিতে পারছে, কাছে দূরে মেঘেদের ছুটে যাওয়া দেখে নিজেই যেন মেঘের সাথে উড়ে উড়ে যাচ্ছে, সেটা পাশের সিটের অন্যজনের কোনো কারনেই সহ্য হবার কথা নয়। তার উপর একজন মনের সুখে ছবি তুলে যাচ্ছে আর অন্যজন শুধু জানালায় তাকিয়ে আছে পাহাড় দেখার হাহাকারে।
আমাদের পাঁচটা সিটের সবার মধ্যেই মোটামুটি এমন একটা স্বন্দ্ব আর মানসিক সংঘাত শুরু হয়ে গেছে যে সুযোগ পেলে জানালার দূরের সিটে যে বসেছে সে দেখিয়ে দেবে। আসার সময় বা চাঁদের গাড়িতে করে রুমা থাকে বগালেক যাবার সময়। আমিও তাতে সম্মতি দিলাম ওদেরকে শান্ত করার জন্য। কারণ এখনই যদি একজনের সাথে অন্যজনের লেগে যায় তাহলে দারুণ মুশকিলের একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে আর পাহাড়ে গিয়ে ট্রেক করার মজাটা ঠিক পাওয়া যাবে না। কেওক্রাডং তো অনেক দূরের পথ। দেখা যাবে রুম বাজার যেতে যেতেই একজনের সাথে আর একজনের ঝগড়া লেগে দল ছন্নছাড়া হয়ে গেছে।

অপার্থিব পাহাড় নদীর রূপ। ছবিঃ সংগ্রহ
তার পরেও কেউ ভীষণ খুশিতে পাহাড়, মেঘ, সবুজ দেখে, ছবি তুলে অন্যকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করে আর কেউ কেউ চাঁদের গাড়িতে পছন্দের জায়গায় বসে থাকে বাসের চেয়েও অনেক ভালো করে পাহাড় দেখে, মেঘ ছুঁয়ে, সবুজে ভেসে ভেসে বগালেক যাবে সেই উচ্ছ্বাসে, সেই আনন্দে আর সেই স্বপ্ন দেখে দেখেই পৌঁছে গিয়েছিলাম রুমা বাজারের কাছে। কাছে বলতে নদীর অন্যপাড়ে। কারণ বাস তখন সাঙ্গুর এপারে দাঁড়াতো, নৌকায় করে নদী পার হয়ে রুমা বাজারে যেতে হতো।

পাহাড়ি পথে… ছবিঃ সংগ্রহ
সবাই মিলে সাঙ্গুর তীরে গাছের ছায়ায় বসে দারুণ আনন্দে আর উত্তেজনা নিয়ে নৌকার অপেক্ষা করতে লাগলাম আর সেই সাথে যারা বাসে জানালার সিটে এসেছে তাদেরকে জানানো হলো যে অন্যরা এবার সবার আগে নিজেদের পছন্দের সিটে বসে যাবে, যেন কেউ কোনো ঝামেলা না করে এসব নিয়ে। তাহলে আর কেওকারাডং যেতে হবে না, তার আগেই ট্রেক আর ট্রিপ শেষ হয়ে যেতে পারে। এই কথা বলাতে সবাই মোটামুটি চাঁদের গাড়ির প্রস্তাব মেনেই নিয়েছিল।