আদরের বোনটার সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। ওর বাড়ি কুমিল্লা আর ফেনীর মাঝামাঝি। কুমিল্লা তো বহুবার যাওয়া হয়েছে, তাই ভাবলাম, এবার ফেনী যাই। তাই খুঁজে পেতে ফেনীতে দেখার মতো জায়গাগুলো বের করলাম। কয়েকজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে একদিনে ঘোরার মতো ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম। আমি আর তাসনু ছাড়াও দলটিতে জুটে গেল সৌরভ, নিলয় এবং সাইফুল্লাহ। ঠিক হলো, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় মিলিত হবো সবাই।
চাঁদপুর থেকে যাবো আমি আর সাইফুল্লাহ। ভেবে দেখলাম, আমাদের জন্য ফেনী যাবার সহজ উপায় হলো ট্রেন। তাই ভোর পাঁচটার মেঘনা এক্সপ্রেস ধরার জন্য আমাদের বাসা থেকে বের হতে হলো ভোর চারটায়। এই শেষরাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে স্টেশনে এসে টিকিট কাউন্টারে সিটিং টিকিট পাওয়া গেল। আগের দিন বিকেলে টিকিট দেওয়ার কথা থাকলেও এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পায়নি সাইফুল্লাহ।

কুমিল্লা জাংশন; source: মাদিহা মৌ
যথা সময়ে ট্রেন এলো। চাঁদপুর কোর্টে ট্রেনটি সম্ভবত পাঁচ মিনিটও দাঁড়ায়নি। তাই লাফ দিয়ে একটা বগিতে উঠে গেলাম। তারপর ট্রেনের ভেতর দিয়ে হেঁটে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত বগিটিতে পৌঁছালাম। শীতে ভোর রাতে একটু একটু করে আলো ফোটার মাধুর্য দেখাতে দেখাতে ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। লাকসাম জাংশনে আধা ঘণ্টার বিরতি পেয়ে রেললাইনে নেমে গেলাম। রেললাইন মানেই ভালোবাসা। কিছুক্ষণ ছবি তুলে উঠে পড়লাম। নিম্নচাপের কারণে ঠাণ্ডা জেঁকে বসেছে।
ঠিক তিন ঘণ্টায় ফেনী পৌঁছালাম। নাস্তা খেয়ে রওনা করলাম ছাগলনাইয়ার দিকে। ফেনী স্টেশন রোডে ছাগলনাইয়ার সিএনজি পাওয়া যায়। ঠিক ১৭ মিনিটে সিএনজি ছাগলনাইয়া পৌঁছে গেল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিলয়ও ছাগলনাইয়া পৌঁছে গেল। তাসনু আর সৌরভের আসতে আরোও দেরি হবে। তাই খুঁজে-পেতে দেখলাম, ছাগলনাইয়ার কাছাকাছি নরমাল কোনো জায়গা আছে কি না। পাওয়াও গেল। শমশের গাজীর দিঘি। দিঘি বলে আগেই এই জায়গাটি বাদ দিয়েছিলাম। ভাবলাম, ওরা আসতে আসতে আমরা জায়গাটা ঘুরে আসি।

চম্পকনগর; source: মাদিহা মৌ
অনেকদূর হেঁটে টিলার উপর খোলা জায়গা পেলাম। তারপরই গাছ গাছালির আড়ালে চোখে পড়লো দীঘিটি। দীঘির ওপারেই ভারতের সীমান্ত। আমরা দীঘির পাশের খোলা প্রান্তরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। প্রান্তরের একধারে বন, অন্যধারে বিস্তৃত সোনালী ধানের ক্ষেত আর তাল গাছের সারি। এখানে বসে আড্ডাটা জমলো দারুণ। খুব কম আশা নিয়ে এসে চমৎকার নৈসর্গিকতা দেখতে পেয়ে দারুণ তৃপ্তি পেলাম।
দীঘির পাশে বাঁশের কেল্লা বা কোনো স্থাপনাই দেখতে পাইনি। জানতে পারলাম, বাঁশের কেল্লায় যেতে হলে আরো সামনে যেতে হবে। অগত্যা আবারোও হাঁটতে শুরু করলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করি, হাত তুলে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। হাঁটছি তো হাঁটছিই। নিলয় বার বার বলছে, ‘আসলেই কি বাঁশের কেল্লা টেল্লা আছে? নাকি বেগার খাটছি?’
আমি বললাম, ‘যাই থাকুক, খুব বেশি প্রত্যাশা করিস না। ধরে নে, বাঁশ দিয়ে বানানো ভাঙাচোরা কিছু একটা হবে। আসলে আমাকে নামটাই খুব টানছে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার মতো কিছু কি না, দেখতে চাই।’

লাল মাটির পাহাড়; source: মাদিহা মৌ
অবশেষে আমাদের গন্তব্য এলো। রিসোর্টের সামনে লাল রঙের প্রবেশদ্বার। এখানে টিকিট কাটার জন্য কোনো লোক নেই, তবে মানুষজন দেখলে ভেতর থেকে লোক এসে টিকিট দিয়ে যায়। ২০ টাকা মূল্যের এই টিকিটটি শুধুমাত্র কেল্লার বহিরাঙ্গন পরিদর্শনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রিসোর্টে অবস্থানকালে টিকিটটি সাথে রাখতে হয়।
টিকিট কেটে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়বে একটি মঞ্চের উপর সাজানো গিটার, একতারা আর তবলার ভাস্কর্য। এর নাম ঐকতান ভাস্কর্য। এর ডান পাশে রিসোর্টের দিকে যাওয়ার ঢালাই করা পথ। পথটি গিয়ে মিশেছে বাঁশের কেল্লার মূল প্রবেশদ্বারে। রিসোর্টটির মূল উপকরণ বাঁশ হলেও এটি কেবল বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়নি। পাকা মেঝে টাইলস করা।
দেয়ালেও ইট সিমেন্টের ব্যবহার আছে। জানালাগুলো থাই গ্লাসের, আর দরজা পুরোটাই কাঁচের। তাই বাইরে থেকে রিসোর্টের অভ্যন্তরীণ সজ্জা দেখা যাচ্ছিলো। তবে কেল্লায় বাঁশের ব্যবহার বেশ দৃষ্টি নন্দন। রিসোর্টের সামনে কাঠমালতি ফুলের ঝোপ। সফেদ কাঠমালতি ফুটে রয়েছে। রিসোর্টের সামনেই খোলা জায়গায় গাছ লাগানো। তারই একধারে বাঁশের মাঁচার উপর ছোট একটা ঘর আছে। এটার কাজ কী, জানতে পারিনি।

শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট; source: মাদিহা মৌ
রিসোর্টের পেছনে একটি জলাশয় আছে। জলাশয়ে নৌভ্রমণ করার জন্য বোট ভাড়া দেওয়া হয়। ২০ মিনিট সময়ে ৪ জন্য নৌকা ভ্রমণ করতে পারে ১০০ টাকা খরচ করে। পুকুর পাড়ে দুটো বানর চেইন দিয়ে বাঁধা। এই জলাশয়টির উপরেই কাঠের সেতু পেরিয়ে ওপাশে দেখি একটা ত্যাঁদড় খরগোশ চুপচাপ বসে আছে। ছবি তুলতে গেলাম, কয়েক লাফে পালিয়ে গেল। এখানটায় দুটো ঘর আছে যেগুলো পুরোটা এক ধরনের লতানো গাছে ছাওয়া। লতানো ঘরের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে চমৎকার ছবি তোলা যায়। রিসোর্টে থাকার জন্য ৮টি রুম আছে। রুমের ভাড়া ৩,৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭,৫০০ টাকার মধ্যে। যদিও এত টাকা খরচ করে এখানে রাত্রিযাপন করার জন্য কোনো ইচ্ছেই জাগেনি আমার।
রিসোর্ট থেকে ছাগলনাইয়া ফিরে দেখা হলো তাসনীম আর সৌরভের সাথে। সবাই খেয়ে রওনা দিলাম বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি আর সাতমঠে। যাওয়ার রাস্তা চিনি না কিছুই। ভাবলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করলে জমিদারবাড়ি যাবার রাস্তা বলে দিতে পারবে। জানতে পারলাম, বাঁশপাড়া যাওয়ার লোকাল সিএনজি নেই। সিএনজিগুলো সব যায় ফেনীর দিকে। এত কাছাকাছি জায়গার যাত্রী তোলে না। তাই ভাবলাম, একটা সিএনজি রিজার্ভ করে ফেলি জমিদার বাড়ি আর মঠ ঘোরার জন্য। সিএনজিওয়ালা ১৫০ টাকা চাইলো। দামাদামি করে ৮০ টাকায় রফা হলো। ওমা! ছাগলনাইয়া বাজার থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সিএনজি আমাদের সাতমঠের সামনে নামিয়ে দিচ্ছে। এইটুকু রাস্তার জন্য ৮০ টাকা নিলো! হেঁটেই আসা যেত। রাগ হলো প্রচণ্ড। বললাম, ‘আমাদের বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি নিয়ে যান’।
সে বলে, এরকম কিছু চেনে না। এই এলাকায় এসব কিছু নেই। তাহলে এত ভাড়া নিলো কেন? জবাব নেই। গজগজ করছে। মেইন রাস্তায় নিয়ে যেতে বললাম। নিয়ে গেল। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে একই জবাব পেলাম। এরকম কিছু তারা চেনে না।

সাত মঠ; source: মাদিহা মৌ
অগত্যা সাতমঠের রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সাতমঠ পৌঁছার আগেই একটা ভাঙাচোরা স্থাপনা পেলাম। ঠিক জমিদার বাড়ির মতো নয়, আবার মঠের মতোও নয়। দুটোর সংমিশ্রণ। ওটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, এটিই বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি নয় তো?
কাছে গিয়ে দেখলাম, পুরোটা স্থাপনা জুড়ে অনেকগুলো প্রবেশদ্বার আছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ভেতরে গেলাম। ঠিক মাঝে একটা বেদী মতোন আছে। এটা দেখে মনে হচ্ছে, এখানে প্রতিমা স্থাপন করা হতো। এটা হয়তো কোনো মন্দির ছিল। এতটা বাজে অবস্থায় জমিদার বাড়ির মন্দির খুব কমই দেখেছি। ভেতরটা এখন টাট্টিখানায় পরিণত হয়েছে। বেরিয়ে এলাম। এরকম অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না।
সাত মঠের দিকে পা বাড়িয়েছি। মঠের একপাশে একটা পুকুর আছে। সাতটা মঠ একসারিতে নয়, দুটো সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। এক সারিতে তিনটি, অন্য সারিতে চারটি। এভাবে একটা সমকোণ তৈরি করেছে। গাছপালার কারণে প্রায় ঢেকে যাওয়া মঠগুলোর অবস্থাও সঙিন। এগুলোর ভেতরেও বাঁশপাড়া মন্দিরটির মতোই অবস্থা। সাতমঠের একটির মাথা গেছে ভেঙে। তাই দূর থেকে ছয়টির মাথা দেখা যায়।

বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি, source: মাদিহা মৌ
ছাগলনাইয়ায় আমাদের সকালটা খুব চমৎকার কাটলেও, সেসব মিস করেছিল তাসনু আর সৌরভ। তাই ঠিক করলাম, ছাগলনাইয়ায় পুরাতন স্থাপত্য খুঁজে না বেড়িয়ে, মুহুরি প্রজেক্টেই চলে যাই। অবশ্য আমরা গুগল করে ছাগলনাইয়া থেকে মুহুরি যাওয়ার যে উপায় পেয়েছিলাম, সেই অনুযায়ী গেলে প্রচুর সময় লাগতো।
মুহুরি প্রজেক্ট যাওয়ার রাস্তা দুটি। একটা মিরসরাই হয়ে, অন্যটি সোনাগাজী উপজেলা হয়ে। নিলয় ছাগলনাইয়া থেকে আসার সময় মিরসরাই হয়ে হাইওয়ে ছেড়ে ভেতর দিক দিয়ে সিএনজি করে এসেছে। আমরাও ঠিক করলাম, ওখান দিয়েই যাবো। এলাম। একবার বাস বদলে, দুইবারে সিএনজি বদলে মুহুরি নদীর ধারে আসতে আমাদের সময় লাগলো ঠিক এক ঘণ্টা। মিরসরাই হাইওয়ে পেরিয়ে এপাশে এসে সিএনজিতে যে রাস্তাটুকু গিয়েছি, এখানকার রাস্তাটা দারুণ সুন্দর। আবার রাস্তার ধারে খুব পুরনো কিছু মঠ আর মন্দিরও চোখে পড়লো।

বায়ুকল; source: মাদিহা মৌ
ব্রিজের এক পাশে অথৈ নদীজল, অথচ অন্যধার ঠিক কাদালেপটা হয়ে আছে। নদীগর্ভের পানি শোষণ করা মেঘরঙা কাদার উপরে একটুখানি পানি গড়াগড়ি করছে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। নদীর পাড়ে বসবাস, সেই সাথে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে কত আকারের কত রকমের ব্রিজ আর নদী দেখেছি, এরকমটি আর কখনোই দেখিনি। এমনকি রাঙামাটির কাপ্তাইয়েও এরকম কিছু দেখা হয়নি। এরকটা এখানেই দেখলাম। ফেনী নদী এখান থেকে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। দক্ষিণ দিকে দূরে ঝাউবন আর বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী চোখে পড়ছিল। তা দেখেই নিশ্চিত হয়েছিলাম ওখানেই সমুদ্র।
ব্রিজের ওপারে গিয়ে রাস্তার পাশের নিচু জমিতে দেখলাম, ওখানে ফুচকা চটপটির আসর বসেছে। ওসব না খেয়ে ভাবলাম, দই খাব। উপরে উঠে একটা দোকানে বড় বড় করে দইয়ের বিজ্ঞাপন লেখা আছে। ওখানেই গেলাম। কাঁচের কাপে করে সাদাটে দই দিয়ে গেল। আহামরি ধরনের কোনো স্বাদ পাইনি। সাধারণ দই মনে হয়েছে। আমার অবাক লাগলো এই ভেবে যে, দইয়ের রঙ একদম সাদা কেনো হবে। দুধ ঘন করলেই তো হলদে একটা ভাব চলে আসে। তাহলে কি মহিষের দুধ ঘন বলে চুলায় তেমন জ্বাল করা হয় না? কে জানে! একেকটি দইয়ের দাম পড়লো ২৫ টাকা করে। দই খেয়ে, সিএনজি রিজার্ভ করে ফিরে এলাম মুহুরি থেকে, সন্ধ্যের মায়াবী আলো খোঁপায় গুঁজে নিয়ে।

মুহুরি প্রজেক্ট, source: মাদিহা মৌ
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেনে ও বাসে ফেনী যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে চাইলে চট্টগ্রামগামী রাতের শেষ ট্রেন তূর্ণা নিশিথায় যেতে পারেন। রাত সাড়ে ১১টায় কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া তূর্ণা নিশিথায় ফেনী পৌঁছে সাড়ে চারটায়। ভাড়া ২৬৫ টাকা।
আবার কম খরচে চট্টগ্রাম মেইলের যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে মাত্র ৯০ টাকা। চট্টগ্রাম মেইল কমলাপুর থেকে ছাড়ে রাত সাড়ে দশটায়। সাত ঘন্টা লাগবে ফেনী পৌঁছাতে। বাসে যেতে চাইলে, এনা ট্রান্সপোর্টে ও স্টার লাইনে যেতে পারেন। ভাড়া ২৭০ টাকা।
Feature Image : মাদিহা মৌ