হোক চাকরি কিংবা ব্যবসা কিংবা কেবল ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনার চাপ; আমাদের জীবনে প্রায়ই চলে আসে দমবন্ধ ভাব। খাঁটি ইংরেজিতে যাকে বলে Hangover. ছুটি-ছাটায় তাই আমরা বের হই, ঘুরতে যাই, হ্যাংওভার কাটাই। আমেরিকান কমেডি মুভি হ্যাংওভার ট্রিলজিতে দেখা যায় কিছু বন্ধু হ্যাংওভার কাটাতে বিভিন্ন জায়গায় যায়, গিয়ে অবশ্য নানা ঝামেলা পাকায় আবার তার হাস্যকর সমাধানও বের হয়। হ্যাংওভার ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবিটার শ্যুট হয় থাইল্যান্ডে আর শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন যে থাইল্যান্ড নিয়েই কথাবার্তা হবে, তাই সেই প্রসঙ্গ টানা।

বহু বছর ধরে থাইল্যান্ডে ভ্রমণ করছেন এবং সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের যাবতীয় পরামর্শ অনুসারেই লেখা হয়েছে এই লেখাটি। হ্যাংওভার কাটাতে থাইল্যান্ড গিয়ে সেই মুভির বন্ধুদের মতো ঝামেলায় না পড়ে কীভাবে সুন্দরভাবে থাইল্যান্ড ভ্রমণ সম্পন্ন করতে পারবেন, সেই বিষয়ক কিছু নির্দেশনাও জানা হয়ে যাবে এর মাধ্যমে।
১. ব্যাংককের ঐতিহ্যবাহী ম্যাসাজ
ওয়াট ফুর ঐতিহাসিক এবং ক্যালাইডোস্কপিক স্থাপত্যের মাঝে অবস্থিত ম্যাসাজ প্যাভিলিয়নগুলোতে আরামদায়ক ম্যাসাজের মাধ্যমে শরীর-মন ফুরফুরে করে নেওয়া থাইল্যান্ডের সবচেয়ে আরামদায়ক অভিজ্ঞতা।
প্রধান কম্পাউন্ডের পূর্ব দিকে অসাধারণ ম্যাসাজ পার্লারগুলো রয়েছে। পুরো ম্যাসাজে আপনার সময় নিবে দুই ঘণ্টা তবে ফাঁকা পেয়ে গিয়ে বসে পড়বেন, এমন ভাবা ভুল। মোটামুটি একটা সিরিয়াল পেরিয়ে তবেই আসবে আপনার এই দারুণ ম্যাসাজের পালা।

২. ঐতিহ্যবাহী থাই থিয়েটার ‘খন’ পারফরম্যান্স দেখা
বর্তমানে যদিও এরকম অনুষ্ঠান অনেক কমে এসেছে, কিন্তু তবুও যদি আপনি ভাগ্যক্রমে খন এর দেখা পেয়ে যান, নির্দ্বিধায় পুরো অনুষ্ঠানটি দেখে ফেলুন। ভুতুড়ে সংগীত, দারুণ কস্টিউম এবং আকর্ষণীয় অভিনয়ে ভরপুর এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোকে থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ শিল্পের খাতির কাতারে ফেলা হয় এবং সেসব স্বচক্ষে দেখবার মতো সৌভাগ্য মিস করা উচিত নয় একদমই।

৩. সৈকতে রৌদ্রস্নান এবং নৌকায় ঘোরাঘুরি
থাইল্যান্ডে গেলে অবশ্যই কো নাঙ ইউয়ান দ্বীপের সৈকতে একবার ঘুরে যাবেন। কাছাকাছি তিনটি দ্বীপের অবস্থান পরিণত হয়েছে পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকতের একটিতে। তাছাড়া সৈকতের সাদা বালি মিশে গেছে দ্বীপের মাটির সাথেও, সব মিলিয়ে পর্যটকদের বেশ ভিড় জমে জায়গাটিতে।

এছাড়াও এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াতের জন্য থাইল্যান্ডের স্থানীয় নৌকার বিকল্প আর কী হতে পারে! কো তাও দ্বীপে যেতে নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনে গেঁথে থাকবে আজীবন।
৪. স্থানীয় উৎসবে অংশ নেওয়া
ইয়াসুথুন রকেট ফেস্টিভ্যালের বর্ণিল, মাতাল করা উৎসবে অংশ নিয়ে আপনার ভ্রমণ হতে পারে আরও রঙিন! এছাড়াও দান সাই এর ফি তা খন উৎসবের পোশাক কিংবা প্যারেডের আনন্দে সামিল হতে ইচ্ছা করবে যে কোনো উৎসব-প্রিয় পর্যটকেরই!

৫. থাই খাবারের স্বাদ গ্রহণ
বাংলাদেশী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই থাই স্যুপ খেয়ে এবং থাই স্যুপের প্রশংসা করেই আমাদের বেড়ে ওঠা আর স্বয়ং থাইল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার স্থানীয় খাবার চেখে দেখবেন না, তা কী করে হয়!
কড়া করে ভাজা ক্যাটফিশের সাথে টমেটো এবং আমের সালাদ, জিভে জল এনে দেওয়া বিফ গ্রিন কারি কিংবা আমের সাথে ভাত এবং নারকেল-দুধের খাবার। সব মিলিয়ে সুস্বাদু খাবারের ভরপেট আয়োজন!

৬. ভ্রমণটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সংগ্রহ করুন স্থানীয় স্যুভনির
হাতে তৈরি নানা রকম শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত দেশ থাইল্যান্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বস্তুটি বলা হয় হালকা সবুজ রঙের Celadon-কে। এটি মাটির তৈরি এক ধরনের তৈজসপত্র। চিয়াঙ মাই শহরে খোঁজ করলে আপনি এটি পাবেন। এছাড়াও সেই শহরেই থাইল্যান্ডের সেরা সব স্যুভনিরগুলো কিনতে পারবেন। থাইল্যান্ডে কেনাকাটার জন্য বেশ ভালো একটা শহর এই চিয়াঙ মাই।

৭. থাইল্যান্ডের দুর্গম অঞ্চলগুলো ভ্রমণ
তিনশ’ কিলোমিটার বিস্তৃত মায় হং সন লুপ থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এখানকার উঁচু কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে থাইল্যান্ডের একটা বড় ল্যান্ডস্কেপ ধরা দেয় পর্যটকদের চোখে। একটি জিপ কিংবা মোটরবাইক ভাড়া করে রোলার-কোস্টার রাইডে চড়ার মতো করে ঘুরে আসুন এই দুর্গম অঞ্চলটি থেকে। এর ফলে বুনো পাহাড়ি সৌন্দর্যের সাথে নতুন করে পরিচিত হতে পারবেন।

৮. চিয়াঙ খান থেকে নঙ খাই রোডট্রিপ
লাওস এবং কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা ইসানের কোলঘেঁষা এই রোডট্রিপে পার্শ্ববর্তী মেকঙ নদী আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে। চিয়াঙ খান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি রাস্তার পাশে অল্প কিছু ছোট কুঁড়েঘর ব্যতীত তেমন আর কিছু দেখা যায় না। ফলে জায়গাটিকে প্রায় বুনো কিংবা প্রাচীন বলেই মনে হয়। শান্ত-নিবিড় সাং খোম গ্রামে যাত্রাবিরতির সময়ই কেবল কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। খাবার পানি সহ অন্যান্য ছোটখাটো সুবিধা সেখানে পাবেন।

৯. প্রিয়জনের সাথে নিরিবিলি সময় কাটান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের মাধ্যমে
থাইল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর ভিউ কোত্থেকে পাওয়া যায় সেটা বের করা খুব কষ্টকর; কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবেন? তবে ব্যাংককের স্কাই বারে বসে আকাশ দেখা কিংবা দূরবর্তী পাহাড়ের পর পাহাড়ের উপর সবুজের সমারোহ উপভোগ করতে দই তুং এর দই চাঙ মুব নামক সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পাহাড়ি উদ্যানে বসে সময় কাটানো অথবা ফ্যাঙ না উপসাগরের তীরের চুনাপাথরের পাহাড়ের চূড়ার ছোট্ট ঘরগুলো থেকে সূর্যাস্ত দেখা- এসব কিছুই আপনার ট্যুরকে করে রাখবে স্মরণীয়।

হানিমুনের উদ্দেশ্যে যারা থাইল্যান্ডে যাওয়ার প্ল্যান করছেন, তারা মাথায় রাখবেন কিন্তু এগুলোর কথা! দরকার হলে হানিমুনের গন্তব্য হিসেবে থাইল্যান্ডের কোন কোন জায়গায় সময় কাটানো সবচেয়ে ভালো হবে, সেটা নিয়ে বিস্তারিত আরেকটা পর্ব লেখা যাবে!
তো এটাই ছিল আমার পক্ষ থেকে আপনাদের আসন্ন থাইল্যান্ড ভ্রমণকে কীভাবে আরও স্মরণীয়, বর্ণীল করে রাখা যায় কিংবা থাইল্যান্ডে বেড়ানোর আসল আনন্দগুলো কীসে সেগুলো নিয়ে কথা বলা। ভিন্ন ভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ান, ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। ভ্রমণের আনন্দ ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে।
ফিচার ছবি: thaiembassy.com